muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

কিশোরগঞ্জের খবর

কিশোরগঞ্জে দুর্গাপ্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় সদর থানার ওসি প্রত্যাহার

কিশোরগঞ্জে দুর্গাপ্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় সদর থানার ওসি প্রত্যাহার

কিশোরগঞ্জে মন্দিরে হামলা চালিয়ে দুর্গাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় সদর মডেল থানার (ওসি) তরিকুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (০৩ অক্টোবর) তাকে জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত অফিসার ইনচার্জ হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সদর মডেল থানার ইন্সপেক্টর তদন্ত শ্যামল মিয়াকে।

এর আগে বৃহস্পতিবার (০৩ অক্টোবর) ভোর রাতে জেলা শহরের বত্রিশ এলাকায় শ্রী শ্রী গোপীনাথ জিউর আখড়ায় দুর্বৃত্তরা প্রতিমা ভাঙচুর চালায়। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় এখনো কাউকে আটক করা যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

জানা যায়, গত ৫ আগস্টের পর থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে কিশোরগঞ্জে রাতভর হিন্দু-মুসলিম মিলে শহরের সব মন্দির, আখড়া পাহারা দেওয়া শুরু করে। জেলায় ৩৬৩টি মন্দিরে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো এ বছর গোপীনাথ জিউর আখড়ায় দুর্গাপূজার আয়োজন করা হচ্ছে। রাতভর নিরাপত্তার কারণে আখড়ায় স্থানীয় গোপীনাথ সংঘ সংগঠনের ছেলেরা মন্দির পাহারায় ছিলেন। রাত ৩টা পর্যন্ত সংগঠনের পাঁচ সদস্য সজাগ ছিলেন। ভোরের দিকে তারা ঘুমিয়ে পড়েন। এ সময় কে বা কারা মন্দিরে প্রবেশ করে সব প্রতিমা ভাঙচুর করে চলে যায়। পরে স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হলে প্রশাসনের লোকজন আখড়া পরিদর্শন করেন।

স্থানীয় পূজারীরা জানায়, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার জন্য ন্যক্কারজনক এ কাজ করা হয়েছে। ভোরের দিকে সব মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমরা এখন পূজা করার বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। এই মন্দিরে এমন কোনো ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবসময় সব পূজা এ মন্দিরে করা হয়। এবারই দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। এ দেশে আমরা তো সবাই একত্রে বসবাস করি। এমন কেন হবে? আমরা কিশোরগঞ্জে সবাই একত্রে যার যার ধর্ম তারা তার তার মতো করে পালন করি। যারা এ ঘটনায় জড়িত তাদের সুষ্ঠু বিচার চাই।

স্থানীয় বাসিন্দা রাজীব সরকার জানান, এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। ধার্মিক ভালো কিন্তু ধর্মান্ধ হওয়া খুব খারাপ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশের মধ্যে এটা কখনো সমর্থন করি না।

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি নারায়ণ দত্ত প্রদীপ বলেন, আমরা পূজা সুন্দরভাবে করতে চাই। তদন্ত সাপেক্ষে যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়েছি। মন্দিরে সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকলেও মন্দিরের পাশের ক্যামেরাগুলো দেখে কারা প্রতিমা ভাঙচুর করেছে তাদের শনাক্ত করার জন্য বলেছি। ঘটনার পরপর জেলা প্রশাসনের লোকজন সকালে মন্দির পরিদর্শন করেছেন। দুপুর ১২টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রশাসনের সব কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি সভা আয়োজন করা হয়েছে।

গোপীনাথ জিউর আখড়ার দুর্গাপূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সজীব কুমার সাহা বলেন, দুমাস ধরে আমরা এ মন্দির পাহারা দিচ্ছি। প্রতিদিন রাতে ৫-৭ মিলে পাহারা দেই। এ বছর প্রথমবারের মতো দুর্গাপূজা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেই অনুযায়ী পূজার আয়োজন করা হয়। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল। এখন শুধু রঙ করা ও সাজানোর বাকি ছিল। এরমধ্যে বৃহস্পতিবার ভোরে সব প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে। আমাদের যারা পাহারায় থাকেন তারা রাত ৩টা পর্যন্ত সজাগ ছিলেন। একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লে কে বা কারা মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করে চলে যায়।

এদিকে এ ঘটনার পর দুপুরে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের সভাপতিত্বে কালেক্টরেট সভাকক্ষে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। পুলিশ সুপার, সেনাবাহিনী ও র‌্যাবসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এতে অংশ নেন। সভায় প্রতিমা ভাঙচুরের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার জন্য দাবি জানান হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা। এ ঘটনার পর জেলার সবগুলো পূজামণ্ডপে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি নারায়ণ দত্ত প্রদীপ জানান, কিশোরগঞ্জে সব সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকে। এটি দুর্বৃত্তদের কাজ। পূজার আগ মূহুর্তে যারা এ রকম ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনতে হবে।

জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী জানান, ঘটনার খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। জেলা প্রশাসক ও সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ ঘটনায় জড়িতদের ধরতে মাঠে নেমেছে পুলিশ। তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। আশপাশের সিসি টিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক, তাদের ছাড় দেয়া হবেনা।

এদিকে দুপুরে এ ঘটনার প্রতিবাদে জেলা শহরের বত্রিশসহ বিভিন্ন এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত হয়। এ সময় বিক্ষোভকারীগণ নানা স্লোগান দেনা। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে শ্লোগান দেয়ার এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান তার কক্ষ থেকে নেমে আসেন।

পরে তিনি বিক্ষুব্ধ সনাতন ধর্মালম্বীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, আপনারা এসেছেন, আপনারা যেমন ভারাক্রান্ত তার থেকে আমিও বেশি ভারাক্রান্ত এই জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবে। সকালে খবরটি পাওয়া মাত্রই আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। আমি মানসিকভাবে খুবই কষ্ঠ পেয়েছি। আমি কি অবস্থায় ছিলাম আপনারা তা জানেন! এই এলাকায় যারা আছেন তাদের সাথে মতবিনিময় করেছি আমরা আপনাদের নিয়েই কাজ করতে চাই। যারা দোষী তাদের চিহ্নিত করে বিচার করা হবে।

তিনি আরও বলেন, এখানে সংখ্যালঘু বলে কোনো কথা নেই। আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক, আমরা সবাই যার যার মত নিজেদের ধর্ম পালন করব। সবাই একত্রে সুন্দর ভাবে থাকবো এটাই তো আমাদের অভিপ্রায়। আমাদের মাঝে যেন কেউ বিভেদ তৈরি করতে না পারে। যতিও একটি স্বার্থান্বেষি মহল বিবেদ তৈরির চেষ্টা করছে । আমাদের সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে একসাথে কাজ করতে হবে। আমরা অলরেডি কাজে লেগে পড়েছি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। আমরা তাদেরকে ধরে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি। ইনশাল্লাহ তাদেরকে আমরা ধরতে পারবো এবং আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য যা যা করার দরকার আমরা তাই করবো।

এই সময় উপস্থিত ছিলেন, কিশোরগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজুল কবির, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রুবেল মাহমুদ, গোপীনাথ সংঘ ও গোপীনাথ মন্দির পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি লিটন সরকার, সাধারণ সম্পাদক সজীব সাহা, কালিবাড়ি মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক পলাশ কুমার রায় প্রমুখ।

Tags: