ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ৫ অগাস্ট সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর, লুট ও অগ্নিসংযোগের তথ্য আসে। তবে এসব অস্বীকার করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।
রোববার ঢাকার আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দলের এক আয়োজনে তিনি এই দাবি করেন।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত রাজধানীতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে শাহাদাতবরণকারী শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন জামায়াত আমির।
জামায়াতের আমির বলেন, আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিস্ট’ মন্ত্রী বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে সরে গেলে দুই দিনে পাঁচ লক্ষ আওয়ামী কর্মীকে হত্যা করা হবে। আমি জিজ্ঞেস করি, এত বড় ‘বিপ্লব’, পরিবর্তনের পর, গণঅভ্যুত্থানের পর পাঁচ লক্ষ লোককে কি হত্যা করা হয়েছে? পাঁচ হাজার? পাঁচশ? পঞ্চাশ? পাঁচ? কিছুই হয়নি।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দানব হতে পারে, কিন্তু এ দেশের মানুষ মানব। এ মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ আছে। দায়িত্ববোধ আছে। যারা এই দেশের মানুষকে ভালোবাসে তারা খুন করতে পারে না।
শফিকুর বলেন, এত বড় পরিবর্তনের পরে আপনাদের আহ্বান করেছিলাম, যে আমরা প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। প্রতিহিংসা আমরা ছড়াব না।
“ওরা ছিল ‘দায়িত্বহীন, বর্বর’। এই জাতি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে। আমরা আহ্বান জানিয়ে বলেছিলাম, ‘শান্ত থাকুন। ধৈর্য ধরুন। প্রিয় দেশ এবং জাতিকে রক্ষা করুন’।”
যারা দেশকে ভালোবাসে না, তারাই খুনি হতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ দেশ কোনো দেশপ্রেমিক পালায় না, পালাবে না। কারা পালায় আপনারা জানেন। আপনারা বলুন তো কারা পালায়? খুনি এবং চোর পালায়। অর্থের পাচার করে বিদেশে পাচার করেছে, এই জন্য এই দেশে থাকার নৈতিক সাহস তারা হারিয়ে ফেলেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারে থাকার সময় ‘বিচারিক হত্যা’ ও ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ করেছে দাবি করে শফিকুর বলেন, দুনিয়ার বিচারটা আমরা দেখতে চাই। এরা যতগুলো মানুষকে খুন করেছে, সবগুলোর ন্যায়বিচার আমরা আদালত থেকে পেতে চাই। আদালতের কাছে আমাদের দাবি স্পষ্ট। আমাদের ওপর যেমনটা ‘জুলুম’ করা হয়েছে, ওদের ওপর সেই জুলুমটা যেন না করা হয়। ওদের যেন ন্যায়বিচার মাধ্যমে ‘আসল’ পাওনাটা বুঝিয়ে দেয়া হয়। তাতে যদি কারও ফাঁসি হয়, হবে; কারও আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়, হবে; কারও যাবজ্জীবন হয়, হবে; যার যেটা পাওনা তা হবে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আপনারাই বলতেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে না। আপনিও (শেখ হাসিনা) তো আইনের ঊর্ধ্বে না। কী অপকর্ম করেছেন, আজকে প্রত্যক্ষ করতে হবে এবং তার স্বাদও গ্রহণ করতে হবে।
ডা. শফিকুর রহমান আরও বলেন, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ফ্যাসিবাদের দোসর মাস্টারমাইন্ড আওয়ামী লীগের লগি বৈঠার তাণ্ডবে বাংলাদেশ পথ হারিয়েছিল। সেদিন শুধু বাংলাদেশ না, পুরো বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। মানুষরূপি বর্বর পশুদের মাধ্যমেই এমন তাণ্ডব সম্ভব। ক্ষমতায় যাওয়ার সীমাহীন লালসা থেকে সেদিন হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। পথ হারিয়ে জাতি ২০০৬ সাল থেকে লড়াই করে বহু জীবন ও তাদের বিনিময়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট মুক্ত হয়েছে।
জামায়াত আমির বলেন, আল্লাহ ক্ষমতা দেওয়ার মালিক, কেড়ে নেওয়ার মালিক। আল্লাহর ফায়সালার সঠিক। কোনো শাসক যখন দেশের মালিকে পরিণত হয় তখন আল্লাহ তাকে ছেড়ে দেন না। আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। শেষ পর্যন্ত তারা আল্লাহর কাছে ধরা খেয়েছে। জুলুমের ক্ষীণ বিচার এ পৃথিবীতে হবে, আসল বিচার হবে আখেরাতে। দুনিয়ার বিচারটাও আমরা দেখতে চাই।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, কথা দিচ্ছি, সব বৈষম্য অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে ততদিন পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাবে যতদিন এসব মুছে না যায়। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত শহীদদের আত্মত্যাগ ও গণআন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে তুলে আনতে হবে। যারা শহীদ হয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন তাদের মর্যাদা দিতে হবে। একেকটা মানুষকে ঘিরে একেকটা পরিবার স্বপ্ন দেখে। প্রত্যেক শহীদ পরিবারের অন্তত একজনকে চাকরি দিয়ে রাষ্ট্রকে তাদের স্বীকৃতি দিতে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আহতদের উপযুক্ত চিকিৎসা নিশ্চিতে ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী সব রাজনৈতিক দলগুলোকে শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়াতে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার আহ্বান জানান জামায়াত আমির।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় অতিথি হিসেবে কূটনৈতিক, বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক নেতারা, আলেম-ওলামা, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধি এবং শহীদ পরিবারের সম্মানিত সহস্রাধিক সদস্য উপস্থিত ছিলেন।