মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ রিপোর্টঃ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশে আরেকটি রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত অধ্যায় সৃষ্টি হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। এই দিন ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী শান্তিপূর্ণ সমাবেশের উপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।
এ গ্রেনেড হামলার প্রধান টার্গেট ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চালানো হয় বর্বরোচিত এ গ্রেনেড হামলা। এতে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। শেখ হাসিনাসহ ৫ শতাধিক মানুষ আহত হন। রোববার(২১ আগস্ট) সেই ভয়াল গ্রেনেড হামলা দিবস।
দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা এবং তত্কালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে ওই সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশের আয়োজন করে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। বিকালে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে খোলা ট্রাকের ওপর স্থাপিত উন্মুক্ত মঞ্চে বক্তৃতা করছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তখন বিকাল ৫টা ২২ মিনিট। বক্তব্য শেষ করে শেখ হাসিনা যখন সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রার উদ্বোধন ঘোষণা করতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই অর্তকিতে গ্রেনেড বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, গুলিস্তান, পুরানা পল্টন এলাকা ও এর আশপাশের এলাকা। চারদিক থেকে সভাস্থলে গ্রেনেড এসে পড়তে থাকে।
মুহূর্তের মধ্যে শান্তির সমাবেশস্থলে রক্তের বন্যা বয়ে যায়। পুরো এলাকাটি পরিণত হয় মৃত্যুর জনপদে। শতশত মানুষের আর্তচিত্কার, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ, রক্ত আর বারুদের পোড়া গন্ধে এক বীভত্স, নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় সেখানে দায়িত্ব পালনরত পুলিশও রহস্যজনক আচরণ শুরু করে। আহতদের সাহায্য করার পরিবর্তে ভীত-সন্ত্রস্ত এবং আহত মানুষের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ করতে এবং মুহূর্মুহু কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকে পুলিশ। মুহূর্তের মধ্যে এলাকার দোকানপাট ও রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেই গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান; কিন্তু গ্রেনেডের আঘাতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি (দলের তত্কালীন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য) মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী ও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক, নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পাননি। শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন তাকে শ্রবণজনিত সমস্যায় ভুগতে হয়।
গ্রেনেড বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে রক্ষা করার জন্য ট্রাকের ওপর মানববর্ম রচনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এই হত্যাযজ্ঞ থেকে দলের নেত্রীকে বাঁচাতে মরিয়া নেতাকর্মীরা তাকে দ্রুত গাড়িতে তুলে দেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে বের হওয়ার পথেই শেখ হাসিনার ব্যবহূত বুলেট প্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতেও ঘাতকরা অবিরাম গুলিবর্ষণ করে।
গ্রেনেড হামলার সেই ভয়াল স্মৃতি আর দলের নেতাকর্মীদের হারানোর বেদনা শেখ হাসিনাকে আজও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। গ্রেনেড হামলায় ২৩ জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় নারী নেত্রী আইভি রহমান সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুযন্ত্রণা সয়ে ২৪ আগস্ট শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
২১ আগস্টের এই গ্রেনেড হামলায় যারা নিহত হন তারা হলেন: মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, রফিকুল ইসলাম আদাচাচা, সুফিয়া বেগম, হাসিনা মমতাজ রীনা, লিটন মুন্সী ওরফে লিটু, রতন সিকদার, মো. হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মামুন মৃধা, বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আতিক সরকার, নাসিরউদ্দিন সরদার, রেজিয়া বেগম, আবুল কাসেম, জাহেদ আলী, মমিন আলী, শামসুদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ, ইছহাক মিয়া এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরো দুজন।
আহতের মধ্যে ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি (দলের তত্কালীন সভাপতিমন্ডলীর সদস্য) জিল্লুর রহমানসহ দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। দীর্ঘদিন চিকিত্সা নিয়ে অনেকে কিছুটা সুস্থ হলেও অনেকেই পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছেন।