ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিজয় দিবসের দিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক বিতর্কিত পোস্ট দেন। সেই পোস্টের প্রতিবাদ জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে কেবল ভারতের বিজয় হিসাবে দেখিয়ে এক পোস্ট দেন। নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্যের পাল্টায় তার দেশেরই সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জে এন দীক্ষিতের লেখার উদ্ধৃতি টেনেছে বাংলাদেশ সরকার।
স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতের প্রথম এই হাই কমিশনার লিখেছেন, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের যৌথ কমান্ডের বাংলাদেশের সেনাপতি এমএজি ওসমানীকে উপস্থিত করতে না পারাটা ছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষের ‘দুর্ভাগ্যজনক স্খলন’। তাকে উপস্থিত রাখতে পারলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক ‘ভুল বোঝাবুঝি’ এড়ানো যেত বলেও মত দিয়েছিলেন ভারতের সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব।
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেইসবুক পাতায় ‘ইতিহাসের তথ্য’ শীর্ষক ওই বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সেখানে মোদির বক্তব্যের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়কে ‘ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়’ দাবি করে ১৬ ডিসেম্বর একটি বক্তব্য দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
তিনি বলেছেন, ‘আজ বিজয় দিবসে, আমরা সম্মান জানাই সেইসব সাহসী সেনাদের সাহস ও আত্মত্যাগকে, যারা ১৯৭১ সালে ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রেখেছেন। তাদের নিঃস্বার্থ আত্মোৎসর্গ ও অটল সংকল্প আমাদের জাতিকে রক্ষা করেছে এবং এনে দিয়েছে আমাদের জন্য গৌরব। এ দিনটিতে তাদের অসাধারণ বীরত্ব ও অদম্য চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাদের আত্মত্যাগ চিরকাল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের জাতির ইতিহাসে গভীরভাবে গেঁথে থাকবে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেন যুদ্ধে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দেয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী।
এর পাল্টায় এক ফেইসবুক পোস্টে ওই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তার ওই বক্তব্যকে ‘ব্যক্তিগত মত’ হিসাবে বর্ণনা করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মঙ্গলবার বলেছিলেন, এ বিষয়ে সরকারের বক্তব্য দেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দীর্ঘ সংগ্রাম এবং ৯ মাসব্যাপী নৃশংস যুদ্ধ সহ্য করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়। ‘লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড : ইন্দো-বাংলাদেশ রিলেশন্স’ শিরোনামে তার বইয়ে, প্রাক্তন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব, কূটনীতিক এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা প্রয়াত জেএন দীক্ষিত লিখেছেন, ‘আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ভারতীয় সামরিক হাইকমান্ডের একটি বড় রাজনৈতিক ভুল ছিল যৌথ কমান্ডের বাংলাদেশ পক্ষের কমান্ডার জেনারেল এমএজি ওসমানির উপস্থিতি নিশ্চিত এবং স্বাক্ষরকারী করতে ব্যর্থতা।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, তার অনুপস্থিতির আনুষ্ঠানিক অজুহাত ছিল যে তার হেলিকপ্টারটি উড্ডয়ন করেছিল কিন্তু আত্মসমর্পণের সময়সূচির অনুযায়ী সময়মতো ঢাকায় পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু ব্যাপক সন্দেহ ছিল যে তার হেলিকপ্টারটি ভুল পথে পাঠানো হয়েছিল যাতে তিনি সময়মতো ঢাকায় পৌঁছাতে না পারেন এবং অনুষ্ঠানে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু ভারতীয় সামরিক কমান্ডারদের ওপর নিবদ্ধ হয়। এটি একটি দুর্ভাগ্যজনক বিচ্যুতি ছিল, যা ভারত এড়াতে পারত। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানির উপস্থিতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম দিনগুলোতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে প্রভাবিত করে এমন অনেক রাজনৈতিক ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে সাহায্য করতে পারত।
আমরা ১৯৭১ সালে আমাদের গৌরবময় বিজয় উদযাপন করি, আমরা সত্য উদযাপন করি বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
কূটনীতিক জেএন দীক্ষিত স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ভারতের প্রথম হাই কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ওই দায়িত্বে থেকে নতুন দেশের পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সাক্ষী হন তিনি।