বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমীর মতো বাংলাদেশের মানুষের কাছেও নেইমার জুনিয়র হলেন স্বপ্নের নায়ক। ব্রাজিল সুপারস্টারকে একনজর দেখাই যেখানে স্বপ্নের মতো ব্যাপার, সেখানে বাংলাদেশেরই একজন নেইমারের 'বন্ধু'। তিনি হলেন কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের গাজিরটেক মোল্লাবাড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ রবিন (৩৪)।
গত ২৫ ডিসেম্বর আমার জন্মদিন ছিল। সেদিন নেইমারের মা নিজে কেক এনে তাঁর বাড়িতে আমার জন্মদিন উদ্যাপন করেন। নেইমারের বাবা আমাকে একটা বাসাও দিয়েছেন সেখানে। বিচের পাশে, নেইমারের জন্মস্থানের কাছে। সাওপাওলোর মোগি দাস ক্রুজেস এলাকায় তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বেশির ভাগ সময় থাকি আমি।’
বাংলাদেশের কোনো যুবকের জন্মদিন উদ্যাপন করেন নেইমারের মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা, অনেকের কাছেই তা অকল্পনীয় মনে হতে পারে।
কিন্তু সেটাই বাস্তব। ঘটনাক্রমে নেইমারের বাবার সেক্রেটারি হয়েছেন রবিন। বন্ধুত্ব হয়েছে নেইমার ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে। কতটা বন্ধুত্ব, শোনা যাক রবিন মিয়ার মুখেই, ‘আমার জন্মদিনে নেইমারের বাবা আমাকে বললেন, চলো, আমরা দুবাই যাব। থার্টি ফার্স্ট উদ্যাপন করব সেখানে। তো আমরা কয়েকজন ব্রাজিল থেকে দুবাই আসি বাণিজ্যিক বিমানে। নেইমার আসে তার নিজস্ব বিমানে। দুবাইয়ের একটা নামী হোটেলে ছিলাম আমরা। নেইমারের সঙ্গে ওর পার্টনার ছিল। সঙ্গে ওর বাবা, ও বড় ছেলেও (দাভিদ লুকা) ছিল। থার্টি ফার্স্টের পরদিন সন্ধ্যায় নেইমার নিজস্ব বিমান নিয়ে সৌদি আরব যায়। আমি যাই বাণিজ্যিক বিমানে। সেখানেও আমি নেইমার ও তার পরিবারের সঙ্গে এক দিন ছিলাম।’
ফুটবল খেলতেন রবিন। ব্রাজিল যান ১৭ বছর আগে। একসময় ইচ্ছা হলো নেইমারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে দেখা করবেন। কিন্তু নানা দিক থেকে চেষ্টা করেও সফল হচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত জোয়াও সেলসোর দেখা পান। এই সেলসো হলো নেইমারের ছোটবেলার বন্ধু।
‘সেলসোকে আমি নেইমারের সঙ্গে দেখা করার কথা বলি। সে আমাকে আশা দেয়। কয়েক মাস পর আমাকে প্যারিস নিয়ে যায় সেলসো। তখন পর্যন্ত আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে নেইমারের দেখা পাব। এটি ২০২০ সালের শেষ দিকের কথা। নেইমার তখন পিএসজিতে খেলে। সেলসো আমাকে নেইমারের বাসায় নিয়ে যায়। বাসায় গিয়ে যার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়, সে-ই হচ্ছে নেইমার।’
প্রথম দেখায় নেইমারকে নিজের কথা, বাংলাদেশের কথা বলেন রবিন। সব শোনেন নেইমার। তাঁর আগ্রহ তৈরি হয় রবিনকে নিয়ে। রবিন স্প্যানিশ-পর্তুগিজসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় কথা বলতে পারেন। ফলে তাঁর সুবিধা হয়েছে নেইমারসহ তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। প্যারিসে নেইমারের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিনেই নেইমারের বাবা নেইমার সিনিয়রের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। তখনই রবিন লক্ষ্য স্থির করেন, এই পরিবারের সঙ্গে কাজ করবেন। এবং তাতে সফল হয়েছেন।
রবিন বলেন, ‘কদিন আগে দুবাইয়ে থার্টি ফার্স্ট উদ্যাপনের পর নেইমারের বাবার সঙ্গে আমার একটা ইভেন্ট ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। তখন ওর বাবার সঙ্গে প্রাইভেট বিমানে আসি। বিমানে নেইমারের ছেলে দাভিদও ছিল। তাকে বার্সেলোনায় নামিয়ে দেয়া হয়েছে, সে সেখানেই থাকে।’
তারপর? রবিন বলতে থাকেন, ‘বার্সেলোনা থেকে নেইমারের বাবাসহ আমরা যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ডোতে গেলাম। সেখানে চার দিনের একটা ইভেন্ট ছিল। সেটি শেষ করে আমি চলে আসি ব্রাজিল। নেইমারের বাবা চলে যান সৌদি আরবে। গত চার বছরে অন্তত আমি ৪০ বারের বেশি নেইমার পরিবারের কারও না কারও সঙ্গে ভ্রমণ করেছি।’
কিন্তু নেইমারের বন্ধু পরিচয়ের চেয়ে রবিন নিজেকে ব্রাজিলের একজন প্রতিষ্ঠিত বাঙালি ব্যবসায়ী বলতে বেশি ভালোবাসেন। ব্রাজিলে তাঁর কিছু ব্যবসা আছে। যার একটি সয়াবিন চাষ। সয়াবিন চাষের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উর্বর জমি পারানাতে।
রবিন বলেন, ‘পারানা স্টেটে ব্রাজিলে পাঁচ হাজার বিঘা জমি আছে আমার। ওই জমির একাংশ পড়েছে ব্রাজিলে, আরেক অংশ প্যারাগুয়েতে। তাই আমাকে লাতিন আমেরিকার একজন কৃষক বলতে পারেন। ব্রাজিলে আমি প্রথম বাংলাদেশি, যে কিনা কৃষিকাজ করছে সেখানে।’
একই সঙ্গে তিনি ফুটবলের সঙ্গেও যুক্ত নানাভাবে। ব্রাজিলের দ্বিতীয় বিভাগের একটি ক্লাবের পরিচালকও। ফুটবলারদের ট্রান্সফার এজেন্ট। ফুটবলের জার্সিসহ নানা সরঞ্জাম বিক্রি করেন ব্রাজিলে।
গতকাল সকালে ব্রাজিল থেকে ঢাকা এসে বিমানবন্দর থেকেই সাভার বিকেএসপিতে যান রবিন। বিকেলে বিকেএসপি ও সেনাবাহিনী নারী ফুটবল দলের প্রীতি ম্যাচ দেখেন। তাঁর কাছে বিকেএসপির ফুটবলাররা নেইমারের নানা গল্প শোনেন। নেইমারের প্রশিক্ষণ ও প্রাত্যহিক জীবন সম্পর্কে রবিন ধারণা দেন বিকেএসপির শিক্ষার্থীদের।
একই সঙ্গে ব্রাজিলে নেইমারের শৈশবের ক্লাব সান্তোস ও ব্রাজিলের অন্য কোনো ক্লাবে বিকেএসপির খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দিতে চেষ্টা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন শিক্ষার্থীদের। এই সুযোগে বিকেএসপির ফুটবল বিভাগকে সৌজন্য উপহার হিসেবে উন্নত মানের পাঁচটি ফুটবল উপহার দিয়েছেন রবিন।
ফুটবল নিয়ে কাজ করে আনন্দ পান তিনি। স্বপ্ন দেখেন, একদিন নেইমারকে বাংলাদেশে আনবেন। কিন্তু কবে? সেটা বলতে পারছেন না এখনই, ‘নেইমার বাংলাদেশে আসতে চায়। কিন্তু সময় মেলাতে পারছে না। তবে একদিন নিশ্চয়ই আসবে।’
পাঁচ-ছয় দিন দেশে থাকবেন রবিন। তারপর সৌদি আরবে যাবেন। সেখান থেকে কোথায় যাবেন, ঠিক করেননি। হয়তো ব্রাজিল বা যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন। নেইমারের জন্মদিন ৫ ফেব্রুয়ারি। যেখানেই জন্মদিন উদ্যাপন করুন মহাতারকা, সেখানেই হয়তো রবিনের যাওয়া হবে, এমনটাই বলছেন তিনি।