“বাহিরে বাঘ, ভিতরে ব্যাঘ্র”— এমন ছিল বাংলার নদীবেষ্টিত ভাটি অঞ্চলের রূপ। আর এরই বুক চিরে ইতিহাসে উত্থান ঘটে এক নামের—ঈসা খাঁ। মুঘল সাম্রাজ্যের ধাক্কা সামলে যিনি গড়ে তুলেছিলেন এক স্বাধীন ভূখণ্ড, নিজের কৌশল, বীরত্ব ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে। কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি দুর্গ ছিল তাঁর প্রতিরোধ সংগ্রামের অন্যতম ঘাঁটি, যা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলার অগ্নিদীপ্ত ইতিহাস।
১৫২৯ সালের ১৮ আগস্ট, আফগানিস্তানের সোলায়মান পার্বত্য অঞ্চলের এক বংশে জন্মগ্রহণ করেন ঈসা খাঁ। পিতা সোলায়মান খাঁ ছিলেন আফগান যোদ্ধা। বাংলার জমিদারদের আমন্ত্রণে ঈসা খাঁ ১৪০০ ঘোড়সওয়ার ও বিপুল গোলাবারুদসহ ত্রিপুরা হয়ে বঙ্গদেশে প্রবেশ করেন। এরপর ইতিহাসের অঙ্গনে তাঁর জয়যাত্রা শুরু হয়।
১৫৮৫ সালে তিনি কোচ সামন্ত লক্ষ্মণ হাজরা ও রাম হাজরাকে পরাজিত করে দখল করেন জঙ্গলবাড়ি দুর্গ। যদিও দুর্গটি প্রাক-মুসলিম যুগের স্থাপত্য, ঈসা খাঁ এটিকে রণকৌশলের জন্য নবনির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলেন। চারদিক ঘেরা জলাধার ‘আরা’ ও নরসুন্ধা নদীর সংযোগ দিয়ে দুর্গটিকে দুর্ভেদ্য করে তোলা হয়। এখানে নির্মাণ হয় রাজদরবার, মসজিদ, পান্থশালা ও বিশাল অন্দরমহল। যুদ্ধের সময় সেখান থেকে ২২টি পরগনা দখল করেছিলেন তিনি।
সোনারগাঁ ছিল তাঁর প্রথম রাজধানী। রাজা চাঁদ রায়ের কন্যা স্বর্ণময়ীকে বিয়ে করার পর ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে তিনি হন সোনাবিবি। কথিত আছে, সোনারগাঁ নামটি সেখান থেকেই এসেছে। তাঁর আমলেই গড়ে ওঠে সোনারগাঁয়ের প্রাসাদ, মসজিদ, এবং প্রশাসনিক কাঠামো।
১৫৯৭ সালে এগারসিন্দুরে মুঘল সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি তলোয়ার যুদ্ধ হয়। ইতিহাস জানায়, ঈসা খাঁর ঘায়ে মানসিংহের তলোয়ার দ্বিখণ্ডিত হয়, এবং পরাজয় ঘটে মুঘলদের। এর আগে কাস্তুলে 'ব্যাটল অব কাম্বল'-এ নিহত হন ঈসা খাঁর পুত্র মাসুম খাঁ—যা তাঁর সংগ্রামের দুঃখগাঁথা হয়ে ইতিহাসে চিহ্নিত।
আজ সেই ঐতিহাসিক দুর্গ কালের স্রোতে ক্ষয়ে গেছে। ছাদের একাংশ ধসে পড়েছে, ৪০ কোঠার অন্দরমহল এখন শুধুই স্মৃতি। জলাধার আরা এবং আশপাশের বহু সম্পত্তি গিলে ফেলেছে স্থানীয় ভূমিদস্যুরা। তবে ইতিহাস থেমে থাকেনি।
বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জঙ্গলবাড়ি দুর্গে খনন কাজ চালাচ্ছে ‘হ্যারিস ম্যাট্রিক্স’ পদ্ধতিতে। ইতোমধ্যেই প্রাপ্ত হয়েছে বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ, মৃৎপাত্র, ইটের প্রাচীর। সরকারের বরাদ্দকৃত প্রায় ২৯ কোটি টাকা দিয়ে জমি অধিগ্রহণ, সংরক্ষণ, ও তথ্যপদ্ধতিগত পুনর্গঠন শুরু হয়েছে। স্থানীয় মানুষ ও ঈসা খাঁর উত্তরসূরিদের দাবিও এই সংরক্ষণচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করেছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা ও ময়মনসিংহ আঞ্চলিক কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় খননকাজ। ‘হ্যারিস ম্যাট্রিক্স’ পদ্ধতিতে পরিচালিত এই খননের মাধ্যমে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে বিভিন্ন সময়পর্বের সাংস্কৃতিক স্তর। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা জানান, "ইটের প্রাচীর, মৃৎপাত্রের টুকরোসহ নানা ধ্বংসাবশেষ ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে, যা সুলতানি, মুঘল এবং তারও পূর্ববর্তী সময়ের সাংস্কৃতিক ইতিহাস ফুটিয়ে তুলবে।"
জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান জানান, দুর্গ সংরক্ষণে ২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। "ভূমি অধিগ্রহণের কাজ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। ক্ষতিপূরণ প্রদান শেষে পূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে," বলেন তিনি। এরই মধ্যে দরবার হল আংশিক পুনর্গঠন করা হয়েছে, যদিও ভেতরের অন্দরমহল এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। পরিকল্পনা রয়েছে একটি পর্যটন ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলার।
স্থানীয় বাসিন্দা দেওয়ান জামান দাদ খান আনোয়ার, যিনি নিজেকে ঈসা খাঁর ১৫তম বংশধর বলে দাবি করেন, বলেন, "আমার বাবার আজীবন স্বপ্ন ছিল দুর্গ সংরক্ষণ করা। এখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খনন করছে দেখে মনে হচ্ছে ইতিহাস সত্যিই বাঁচছে।"
ঐতিহাসিকদের মতে, “বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে ঈসা খাঁ একমাত্র ব্যক্তি, যিনি কেন্দ্রীয় শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীন রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন।” সেই ইতিহাসের সুরক্ষা কেবল স্থাপত্য নয়, বরং আত্মপরিচয়ের এক প্রয়োজন।
জঙ্গলবাড়ি দুর্গ এখন আর শুধু এক ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়, হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের মুক্তচিন্তা ও প্রতিরোধের এক জীবন্ত জাদুঘর। প্রয়োজন কেবল একটুখানি যত্ন, ইতিহাসের প্রতিও দায়িত্বশীলতা।