বাংলাদেশে বজ্রপাতে বছরে গড়ে প্রাণ হারান ৩০০ জন এবং সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ জেলা সুনামগঞ্জসহ সিলেটের চার জেলা ও নেত্রকোণা; এই তথ্য এসেছে এক আলোচনা সভায়। বজ্রপাত বিষয়ক অগ্রিম সতর্কতা কার্যক্রমের প্রচার প্রান্তিক পর্যায়ে বাড়ানোর লক্ষ্যে মঙ্গলবার বিকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রে যৌথ এই আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘রিজিওনাল ইন্টিগ্রেটেড মাল্টি হ্যাজার্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’-রাইমস এর সহায়তায় বজ্রপাত বিষয়ক অগ্রিম সতর্কতা জানাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাইমস এর আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ খান মো. গোলাম রাব্বানি।
তিনি বলেন, “সাধারণত কিউমুলোনিম্বাস নামে এক ধরণের বিশেষ মেঘের মধ্যকার অপেক্ষাকৃত ছোট জলের কণা এবং অপেক্ষাকৃত বড় জলের কণার সংঘর্ষের ফলে বজ্রপাত সংঘটিত হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশে গড়ে প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সিলেটের অন্য জেলাগুলি সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ।”
রাব্বানি বলেন, “বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব জেলাগুলিতে এপ্রিল ও মে মাস সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত সংঘটিত হয় এবং এর কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করে কৃষক। আর এই ঘটনাগুলি সবচেয়ে বেশি ঘটে সকালে বা সন্ধ্যায় যখন কৃষক মাঠে যায়, কাজ করে বা কাজ শেষে বাড়িতে আসে। “সচেতনতা, উচ্চ প্রযুক্তির পূর্বাভাস (নাউকাস্টিং, ফোরকাস্টিং) ব্যবস্থা, বজ্রপাত নিরোধকযুক্ত নিরাপদ ঘরবাড়ি ও আশ্রয়কেন্দ্র বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে পারে।”
গেল ২৮ এপ্রিল একদিনে নয় জেলায় বজ্রপাতে প্রাণ গেছে ১৫ জনের। বজ্রপাতে প্রাণহানি বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “নাসার প্রকাশিত এক রিপোর্টে বাংলাদেশে বজ্রপাত বৃদ্ধির জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঝড়ের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণের কথা বলা হয়েছে। ভবিষ্যতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে, বজ্রপাতের সংখ্যা ১০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।”
রাব্বানি বলেন, ”একটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ২৭ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সৃষ্টি হতে পারে। যা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ। একটি সাধারণ বজ্রপাতে ৩০ কোটি ভোল্ট ও ৩০ হাজার অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, যেখানে সাধারণ বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ মাত্র ১২০ ভোল্ট ও ১৫ অ্যাম্পিয়ার।” তিনি জানান, ২০১৬ থেকে ২৩ সাল পর্যন্ত বছরে দেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১২০টি বজ্রপাত হয়েছে। মোট বজ্রপাতের ৩৩ শতাংশই ভূমিতে আঘাত করেছে।
আকাশে কালো মেঘ দেখা গেলে বা বজ্রপাতের শব্দ শোনা গেলে নিরাপদ স্থানে, যেমন-ঘরে অথবা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করতে হবে। বজ্রপাতের সর্বশেষ শব্দ শোনার পর থেকে কমপক্ষে ৩০ মিনিট নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে হবে। বজ্রপাতের সময় মাঠে কাজ করা নিরাপদ নয়। বাইরে কাজ করা অবস্থায় আশ্রয়ের জায়গা না থাকলে, মাটিতে গুটিসুটি হয়ে বসতে হবে; কোনো অবস্থাতেই মাটিতে শুয়ে পড়া যাবে না। বজ্রপাতের সময় জনসমাগম বা খোলা স্থানে দলবদ্ধ হয়ে এক জায়গায় অবস্থান না করে চারদিকে ছড়িয়ে যেতে হবে। বজ্রপাতের সময় জলাশয়ে থাকা নিরাপদ না। নৌকায় থাকলে নৌকার ছইয়ের নিচে আশ্রয় নিতে হবে, ছই না থাকলে নিচু হয়ে নৌকার পাটাতনে কম স্পর্শ রেখে বসতে হবে ও মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে।
বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে দাঁড়ানো নিরাপদ নয়। বজ্রপাতের সময় কোনো উঁচু স্থানে অবস্থান করা যাবে না। বৈদ্যুতিক খুঁটি ও ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় বাড়িতে অবস্থানকালে, বাসার ছাদে, দরজা-জানালার কাছে বা জানালার গ্রিল ধরে থাকা যাবে না। দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হবে। বাথরুমের কল, রান্নাঘরের সিঙ্ক, পাইপ, তারযুক্ত ফোন, বৈদ্যুতিক লাইনে সংযুক্ত থাকা কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ স্পর্শ করা যাবে না। বৈদ্যুতিক লাইনে সংযুক্ত অবস্থায় টেলিভিশন ব্যবহার নিরাপদ নয়।
বজ্রপাতের সময় খোলা স্থানে স্থাপিত তাঁবু, চতুর্দিকে খোলা ছোট চালাযুক্ত স্থান, খোলা ও ধাতু নির্মিত যাত্রী ছাউনির নিচে অবস্থান করা যাবে না। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিকে স্পর্শ করা সম্পূর্ণ নিরাপদ। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিকে অতিদ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মমিনুল ইসলাম, উপ-পরিচালক এস এম কামরুল হাসান, আন্তর্জাতিক মহাশাখার পরিচালক শামীম আহসান ভূঁইয়া, সহকারী যোগাযোগ প্রকৌশলী রাজিয়া সুলতানা, আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক।