দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের সবগুলো সুপারিশের পক্ষেই মোটাদাগে রাজনৈতিক দলগুলো নীতিগতভাবে একমত বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ।
সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় প্রথম দফার সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া মতামতের বিষয় জানাতে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়েও দলগুলোর মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। তবে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্নে এখন ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।
এর মধ্যে বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতবার নির্বাচিত হতে পারবেন, একজন সংসদ সদস্য কতগুলো পদে থাকতে পারবেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী হবে, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া কি হবে এই ধরনের মৌলিক কাঠামোগত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অমীমাংসিত থেকে গেছে বলে জানান তিনি।
সংসদ ভবনের এলডি হলে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেছেন, এসব বিষয়ে অনেক দলই আরো আলোচনার কথা বলেছে এবং আলোচনায় নমনীয়তা দেখিয়েছে। এ সময় প্রশ্নে আলী রিয়াজ বলেন, “(সংস্কারের সুপারিশ) বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকারের। রাজনৈতিক দলগুলো নির্ধারণ করবে প্রক্রিয়াটা কী হবে।”আলী রীয়াজ বলেন, দুদক সংস্কারে কমিশনের সব সুপারিশের পক্ষেই মোটাদাগে রাজনৈতিক দলগুলো নীতিগতভাবে একমত হয়েছে।
তিনি বলেন, “এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় ও আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের সুপারিশের বিষয়ে সব দল একমত পোষণ করেছে। দুদকের স্বাধীনতা, কার্যকরতা ও গতিশীলতার পাশাপাশি এর স্বচ্ছতা, নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তাবিত সব সুপারিশ সম্পর্কে প্রায় সব দলই সম্পূর্ণ একমত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে। দু-একটি দল বিষয়টি নিয়ে নির্বাচিত সংসদে আলোচনা হতে পারে বলে মত দিয়েছে। দুদক সংস্কারে আরও যেসব সুপারিশের দলগুলো একমত হয়েছে সেগুলো হলো-
দুর্নীতিবিরোধী ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করে ন্যায়পালকে দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় কৌশলপত্রের যথাযথ প্রতিপালন নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতায়িত করার প্রস্তাবে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছে। তবে এই বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে গেছে, কেননা কোনো কোনো দল এই বিষয়ে আংশিক একমত। রাজনৈতিক ও নির্বাচনি অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিতের লক্ষ্যে আনীত প্রস্তাবে নীতিগতভাবে বা আংশিক একমত হয়েছে সবগুলো দল। সেবা প্রদানকারী সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা কার্যক্রম ও তথ্য-ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ (এন্ড-টু-এন্ড) অটোমেশনের আওতায় আনার প্রস্তাবে সব দল একমত পোষণ করেছে। কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীযভাবে কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড ও উন্মুক্ত সরকার ব্যবস্থায় সহায়ক হিসেবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয়ভাবে Open Government Partnership এর পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রস্তাবে অধিকাংশ দল একমত পোষণ করেছে।
ইউএন কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট করাপশন এর অনুচ্ছেদ ২১ অনুসারে বেসরকারি খাতের ঘুষ লেনদেনকে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে শাস্তির আওতায় আনার সুপারিশের বিষয়ে সব দল একমত পোষণ করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে আট সদস্যের দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন কাজ শুরু করে গত ৩ অক্টোবর। ১৫ জানুয়ারি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেয় সংস্কার কমিশন, যেখানে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সংবিধানের অঙ্গীকার, দুর্নীতি বিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন, ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা ও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের প্রস্তাবসহ ৪৭ দফা সুপারিশ করা হয়।
আলী রিয়াজ বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে নীতিগত ঐকমত্য হলেও অনেক বিষয়ে আরো আলোচনার প্রয়োজন আছে। যেসব সুপারিশের বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। “তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে কোনো রকম দ্বিমত নেই,” বলেন আলী রীয়াজ।
১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন হলেও তখন বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করা হয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান এনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংসদে পাস করে বিএনপি। পরে আদালতের এক রায়ের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বিলুপ্ত করা হয়। হাই কোর্ট গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ওই সংশোধনীর আংশিক অবৈধ ঘোষণা করে। এর মধ্যে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকেই বৈধতা দেওয়া হয়। সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়,
সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে ‘বহুত্ববাদ’ না রাখার ব্যাপারে অধিকাংশ দল মতামত দিয়েছে। অন্য চারটি মূলনীতির ব্যাপারে এক ধরনের ঐকমত্য আছে। তবে অনেক দল এই চারটির বাইরেও অন্যান্য বিষয় যুক্ত করার কথা বলেছে। নাগরিকদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার সম্প্রসারিত করা এবং সেগুলোর কিছু কিছু বিষয় রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা তৈরি করা। তবে এই অধিকারের তালিকা এবং তার প্রয়োগে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা এবং বিশেষ করে তার মাত্রা বিষয়ে মতপার্থক্য আছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কিছু দল অবশ্য এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। নিম্নকক্ষে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণের প্রশ্নে এক ধরনের ঐকমত্য রয়েছে দলগুলোর মধ্যে। তবে এর পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। যারা সংসদের উভয় কক্ষের পক্ষে এবং যারা এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভার পক্ষে উভয়ই আইন সভার ব্যাপারে ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়ার পক্ষে। উচ্চকক্ষ গঠনকে সে সব দল সমর্থন করে তাঁরা ১০০ জন সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠনের ব্যাপারে একমত। তবে এই প্রতিনিধিদের কীভাবে নির্বাচন করা হবে সংবিধান সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারের সুপারিশে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকলেও এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।
সংবিধানের ৪৮-(ক) অনুচ্ছেদ যা কার্যত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নির্ধারণ করে, তা সংশোধনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে হবে সেই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। গত ১৫ জানুয়ারি সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রধান উপদেষ্টার হাতে তাদের প্রতিবেদন তুলে দেন, যেখানে নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল, প্রধানমন্ত্রী ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিভিন্ন রূপরেখা প্রস্তাব করা হয়।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত অক্টোবরে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিনের প্রতিবেদন জমা পড়ে ফেব্রুয়ারি মাসে। এসব প্রতিবেদনের সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তারা সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত জানতে চায়- যাদের মধ্যে ৩৩টি মতামত জানায়। পরে তাদের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ শেষে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে আসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মে মাসের শেষে বা জুনের শুরুতে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু হবে। “আমরা আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব হবে। জুলাই মাসের মধ্যে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব হবে।” সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, এমদাদুল হক, আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।