muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

হোসেনপুর

নিশ্ছিদ্র নীরবতায় দাঁড়িয়ে হোসেনপুরের সাহেববাড়ি ও নীলকুঠি শোষণের ইতিহাস বয়ে চলেছে

নিশ্ছিদ্র নীরবতায় দাঁড়িয়ে হোসেনপুরের সাহেববাড়ি ও নীলকুঠি শোষণের ইতিহাস বয়ে চলেছে

বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার সিদলা ইউনিয়নের চৌদার ও টান সিদলা, দুই গ্রামের মাঝে একদা প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে দুটো জরাজীর্ণ স্থাপনা। চারদিক থেকে ধসে পড়া দেয়াল, শ্যাওলা ধরা ইট, আর ঝোপঝাড়ে ঢাকা প্রাচীন পুকুর, সব মিলিয়ে এগুলো যেন নিপীড়িত কৃষকসমাজের কান্না ধরে রাখা এক ইতিহাসের নীরব দলিল।

সুলুকসন্ধানে জানা যায়, ১৭৩০ থেকে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেছিল একটি রেস্টহাউজ, যা সাহেবদের আবাসস্থল এবং একটি নীলকুঠি, যা ছিল মূলত নীলচাষের প্রশাসনিক ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র। এই কুঠির পাশেই রয়েছে একটি প্রাচীন পুকুর, যা সেই সময় সাহেবদের দৈনন্দিন ব্যবহারের অংশ ছিল। স্থানীয়রা এখনো চেনেন এটি ‘সাহেবের গাঁও’ নামে।

নীলচাষ, যে শব্দটি বাংলার কৃষকদের জন্য হয়ে উঠেছিল জুলুম আর শোষণের প্রতীক। তার পিছনে ছিল প্রশাসনিক ক্ষমতা, দমনমূলক নীতি ও শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন। “নীল বাঁদরে সোনার বাঙলা, করলো এবার ছারখার…” কবি হরিশচন্দ্র মিত্রের এই লাইনটি কেবল কবিতা নয়, বরং বাংলার প্রতিরোধ আন্দোলনের এক মুখপত্র।

এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে একসময় কৃষক সমাজ, রাজনৈতিক কর্মী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী সবাই জোট বাঁধে। উইলিয়াম লং-এর মতো নীলকররা স্থানীয় জনরোষের মুখে পড়েন। ইতিহাসবিদদের মতে, হোসেনপুরের নীলকুঠি ও সাহেববাড়ির দেয়ালে যেন আজও প্রতিধ্বনিত হয় সে সময়কার হাহাকার, জেদ আর প্রতিবাদের শব্দ।

তবে ইতিহাসের এমন গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন আজ পড়ে আছে অবহেলায়। কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ নেই, নেই স্থানীয় প্রশাসনের তেমন মনোযোগ। বরং দিন দিন এগুলো দখলদারদের কবলে যাচ্ছে। টান সিদলার পুকুরটিও হারাতে বসেছে তার ঐতিহাসিক পরিচয়।

ড. হালিম দাদ খান, ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষক, বলেন, “এই স্থাপনাগুলো নিছক ভবন নয়। এগুলো শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া এক সমাজের সাক্ষী। আমরা যদি এগুলো সংরক্ষণ না করি, তাহলে শুধু গড়ন নয়, হারাবো এক পর্ব ইতিহাসকেও।”

স্থানীয়দের মধ্যে এখন কিছুটা হলেও সচেতনতা বাড়ছে। কিশোরগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্যপিয়াসী তরুণ সমাজ, গবেষক ও পর্যটকেরা চাইছেন এই এলাকাকে একটি ঘোষিত ঐতিহাসিক জোন হিসেবে উন্নীত করতে।

তবে তার জন্য দরকার একটি সমন্বিত উদ্যোগ- স্থানীয় প্রশাসন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে। ইতিহাস যদি হারিয়ে যায়, তা আর কোনো সাহেববাড়ি দিয়ে ফিরে আসে না।

Tags: