muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

করিমগঞ্জ

নিশ্ছিদ্র প্রকৃতির কোলে নতুন পর্যটন-আবিষ্কার সিংরইল পদ্মবিল

নিশ্ছিদ্র প্রকৃতির কোলে নতুন পর্যটন-আবিষ্কার সিংরইল পদ্মবিল

বর্ষা শেষে শরতের শুরুতেই যখন গ্রামবাংলার আকাশজুড়ে রোদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা, ঠিক তখনই কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার করাতি গ্রামের সিংরইল বিলে দেখা মেলে প্রকৃতির আরেকটা পরিপূর্ণ বিস্ময়ের—সহস্র গোলাপি পদ্মফুলের অমল সৌন্দর্য। চোখের পাতা নামাতে না পারা সেই রূপ দর্শনে প্রতিদিনই ভিড় করছে শত শত মানুষ—নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, প্রেমিক, কবি ও পর্যটক।

নানা বয়সের মানুষেরা বন্ধু-স্বজন নিয়ে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় চড়ে প্রবেশ করছেন এই জলজ কাব্যের রাজ্যে। কেউ গুনগুন করে গান গায়, কেউ মুগ্ধ হয়ে আবৃত্তি করেন জীবনানন্দ, কেউ আবার নীরব থেকে চোখভরা বিস্ময়ে গিলেন বিলের সুনসান অপার সৌন্দর্য। পদ্মের ডগায় খেলা করে ভ্রমর, পাশে উড়ছে বক, দূরে জলজ উদ্ভিদের ফাঁকে ঝাঁপ দিচ্ছে সাপ। এসবের মাঝেই প্রকৃতি যেন চুপিচুপি বলে ওঠে—এই রূপ ভুলে যেও না।

স্থানীয়রা বলছেন, আগেও এসব বিলে পদ্মফুল ফুটত। কিন্তু শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন, যান্ত্রিকতা আর পরিবেশ সচেতনতার অভাবে আজ বিলগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে। সিংরইল বিল যেন এক বিরল ব্যতিক্রম।

মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী অরুন্ধতী চক্রবর্তী ছোট ভাই ও বাবাকে নিয়ে পদ্মবিল ঘুরে সদ্য ডিঙি নৌকা থেকে নামছেন। জানালেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে আগ্রহ জন্মায়। বাস্তবে এসে মুগ্ধ—“ভাবিনি, এমন মনকাড়া দৃশ্য দেখব,” বললেন হাসিমুখে।

স্থানীয় শিশু-কিশোররাও বসে নেই। ছোট নৌকা নিয়ে তারাও এখন নৌচালনা আর গাইডিং করে। বাড়তি আয় তো বটেই, নিজ গ্রামকে ভালোবেসে গর্বিত চোখে দেখতেও শিখছে।

পর্যটকদের আনন্দের মাঝেই উঠে এসেছে কিছু আশঙ্কার কথাও। ‘সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি’র কর্মী কামরুল হাসান খান জুয়েল বলেন, “পদ্মবিলের অস্তিত্ব রক্ষায় ফুল না তোলার ব্যাপারে সচেতনতা জরুরি। স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।”

গণমাধ্যমকর্মী আশরাফুল ইসলাম তুষার বলেন, “চিরায়ত বাংলার প্রতীক এ ধরনের বিলগুলো এখন দুর্লভ। তাই এদের টিকিয়ে রাখতে নাগরিকদের পাশাপাশি প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকাও জরুরি।”

ধর্মীয় প্রেক্ষাপটেও এই পদ্মফুলের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শিক্ষক রঞ্জন কুমার সরকার জানান, আসন্ন দুর্গাপূজায় পূজার্চনায় ১০৮টি পদ্মফুল অপরিহার্য। “এই বিল পূজার জন্যও ভরসার জায়গা,” বললেন তিনি।

পরিবেশ আন্দোলনকর্মী অ্যাডভোকেট মায়া ভৌমিক বলেন, “বিল-ঝিল রক্ষা শুধু পর্যটনের জন্য নয়, বরং পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্যও জরুরি। পদ্ম-শাপলার উপস্থিতি প্রকৃতিকে জীবন্ত রাখে।”

করিমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার জানান, সিংরইল পদ্মবিলে আগত পর্যটকদের অভিজ্ঞতা নির্বিঘ্ন রাখতে স্থানীয় চেয়ারম্যানের সমন্বয়ে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত বছর বিলের প্রবেশ পথ সংস্কার করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে পর্যটকদের জন্য আরও ব্যবস্থাপনা জোরদার করার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।

সিংরইল পদ্মবিল—এ যেন বাংলার হাওরের বুকজুড়ে লেখা গোলাপি রূপকথা। যেখানে প্রকৃতি এখনও প্রাণ খুলে হাসে।

Tags: