জুলাই গণঅভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
হাসিনা ১৫ মাস আগের ওই অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে এখন পালিয়ে আছেন ভারতে। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম সাবেক সরকারপ্রধান, যাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হলো।
আর সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকেই শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজার রায় এল, যে আদালত তার সরকার গঠন করেছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য।
এই ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগের আমলে জামায়াতে ইসলামীর পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং বিএনপির একজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এ মামলার রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই বিচারক হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
৪৫৩ পৃষ্ঠার এই রায়ে মোট ছয়টি অংশ ছিল।
ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় সদস্য বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী এবং প্রথম সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ রায়ের দুটি অংশ পড়ে শোনান। সবশেষে আসামিদের সাজার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার।
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের এই রায় এল তার বিয়ে বার্ষিকীর দিনে। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল।
মামলার আসামিদের মধ্যে হাসিনার মত কামালও ভারতে পালিয়ে আছেন। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন কেবল সাবেক আইজিপি মামুন।
রায়ের জন্য এদিন সকালে মামুনকে আদালতে হাজির করা হয়। রায় শেষে তাকে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয় কারাগারে।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের ঘটনা সারা বিশ্বের নজর কেড়েছিল। ফলে তার রায়ের দিনে পুরো বাংলাদেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর নজর ছিল ট্রাইব্যুনালের দিকে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত এ মামলার রায় ঘোষণার কার্যক্রম আদালত থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
কোন অপরাধে কী সাজা
জুলাই আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট ৫ অভিযোগ আনা হয়েছিল এ মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে প্রথম অভিযোগে ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য দিয়ে ছাত্র-জনতাকে হত্যার প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য শেখ হাসিনাকে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ড।
দ্বিতীয় অভিযোগে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ‘হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ’, চতুর্থ অভিযোগে চাঁনখারপুলে ছয় হত্যা এবং পঞ্চম অভিযোগে আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনাতেও শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত। এই তিন অভিযোগ মিলিয়ে তাকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
চতুর্থ অভিযোগে চাঁনখারপুলে ছয় হত্যা এবং পঞ্চম অভিযোগে আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে ট্রাইব্যুনাল।
তাদের মধ্যে কামালকে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। আর মামুন রাজসাক্ষী হিসেবে তথ্য দিয়ে অপরাধ প্রমাণে সহযোগিতা করায় তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ডের লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে তাদের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে জব্দের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার আসামিদের সাজা ঘোষণা করে বলেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ২০ (৩) ধারা অনুযায়ী, প্রচলিত রেওয়াজ মাফিক কার্যকর করা হবে।
বাংলাদেশের রেওয়াজ অনুযায়ী, বেসামরিক আদালতের রায়ে আসামিকে আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করারও সুযোগ পাবেন। তবে হাসিনা ও কামাল পলাতক থাকায় আপিল করতে চাইলে তাদের ট্রাইব্যুনাল আত্মসমর্পণ করে এক মাসের মধ্যে আপিল করতে হবে।
কার কী প্রতিক্রিয়া
ঢাকায় এ রায় হওয়ার পরপরই ভারত থেকে বিবৃতি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি শেখ হাসিনা। তার সেই বিবৃতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো প্রকাশ করেছে।
এ রায়কে ‘পক্ষপাতদুষ্ট এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যা দিয়ে হাসিনা সেখানে বলেছেন, “আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘৃণ্য আদেশের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের চরমপন্থি ব্যক্তিরা আমাকে হত্যার যে মনোভাব প্রকাশ করছে—বাংলাদেশের সর্বশেষ নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া এবং আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করার লক্ষ্যই সেখানে স্পষ্ট।”
অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনে নিহতদের পরিবার ও আহতরা ঢাকায় ট্রাইব্যুনালের সামনে এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। 'এই মাত্র খবর এল, খুনি হাসিনার ফাঁসি হল' স্লোগান দিতে দিতে তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন।
ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমরা মনে করি এই রায়টি কনো ধরনের কোনো অতীতের প্রতিশোধ নয়। এটি হচ্ছে জাতির প্রতিজ্ঞা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। এটা হচ্ছে জাতির কোয়েস্ট ফর জাস্টিস।
“এই রায় প্রমাণ করেছে- অপরাধী যত বড় হোক, যত ক্ষমতাশালী হোক সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এবং বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে যত বড় অপরাধীই হোক, তার অপরাধের জন্য তাকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে এবং তার প্রাপ্য শাস্তি পেতে হবে।”
তাজুল বলেন, “বাংলাদেশে যে ১৪০০ তরতাজা তরুণ প্রাণ এই স্বৈরশাসনের অবসানের জন্য জীবন দিয়েছেন, তাদের পরিবারে যদি সামান্য একটু স্বস্তি আসে, সেটিই আজকের এই প্রসিকিউশনের প্রাপ্তি।
“জাতির পক্ষে আমরা একটা বিচারিক প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করার মাধ্যমে এই জাতিকে বিচারহীনতার কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার যে ক্ষুদ্র আমাদের প্রয়াস, সেটা যদি সফল হয় সেখানেই আমাদের সাফল্য।”
‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড’ মেনে এ বিচারের রায় হয়েছে দাবি করে তাজুল বলেন, “আমরা এটাও একই সাথে বলতে চাই, যে কোয়ালিটি অফ এভিডেন্স এখানে দেখানো হয়েছে, যে ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ এই আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে, বিশ্বের যে কোনো আদালতের স্ট্যান্ডার্ডে এই সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো উত্তীর্ণ হয়ে যাবে।
“এবং পৃথিবীর যেকোনো আদালতে এই সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হলে আজকে যেসব আসামিকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই সেই শাস্তি পাবেন।”
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা মনে করি, শহীদদের প্রতি, দেশের প্রতি, এদেশের মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি সংবিধানের প্রতি, আইনের শাসনের প্রতি আগামী প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা পরিশোধের স্বার্থে এ রায় একটি যুগান্তকারী রায়। এ রায় প্রশান্তি আনবে, ভবিষ্যতের প্রতি একটা বার্তা, বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের প্রতি মাইলফলক হয়ে থাকবে।"
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এ মামলার মধ্যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ইস্যু ছিল না বলে ওই বিষয়ে তারা (ট্রাইব্যুনাল) কোনো কমেন্টস করেননি। শেখ হাসিনা এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের বাংলাদেশের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
রায় বাস্তবায়ন কীভাবে হবে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “রায় বাস্তবায়ন আইনি পথেই, আইনসঙ্গতভাবেই হবে। বেআইনি বা আইনসঙ্গত নয়–এমন পথ সরকার অবলম্বন করবে না।”
আদালতের দৃষ্টিতে পলাতক শেখ হাসিনা এ মামলার শুনানিতে সরাসরি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জুলাই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে তার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেনও তাকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমির হোসেন বলেন, "রায়টা আমার পক্ষে হয়নি, বিপক্ষে গেছে। এজন্য আমি ক্ষুদ্ধ। কষ্ট লালন করতেছি। আসামিদের ফাঁসির রায়ে আমি কষ্ট পেয়েছি।"
হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “দেশের ১৮ কোটি মানুষের যে গণআকাঙ্ক্ষা ছিল এই রায়, ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের আগে করে যাবেন, এটা আমাদের দাবি ছিল। সেটি পূরণ হয়েছে।”
আর চব্বিশের অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম ভারতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “হাজারের অধিক হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি (শেখ হাসিনা)। আপনারা (ভারত) যদি বাংলাদেশে তাকে (শেখ হাসিনা) ফিরিয়ে দিয়ে সহযোগিতা করেন, তবেই বাংলাদেশের সাথে আপনাদের যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
“কিন্তু শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে না দিলে, বাংলাদেশের সঙ্গে, বাংলাদেশের মানুষের সাথে ভারতের সম্পর্ক কখনোই স্বাভাবিক হবে না। পাশাপাশি আমরা দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করার দাবি করছি। কারণ এই হত্যাযজ্ঞ আওয়ামী লীগেরও।”
রায়ের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও এ বিষয়ে কথা বলেন।
তিনি বলেন, “আমরা শেখ হাসিনার প্রত্যার্পণের জন্য ভারতের কাছে আবার চিঠি লিখব। ভারত যদি এই গণহত্যাকারীকে আশ্রয় দেওয়া অব্যাহত রাখে, তাহলে ভারতকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে একটা শত্রুতা এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় আচরণ।
“আমরা যতদিন আছি এই বিচারকাজ চলবে। আশা করি আগামীতে যেই সরকারই নির্বাচিত হবে এই বিচারের গুরুদায়িত্ব থেকে কোনো অবস্থাতেই যেন পিছপা না হয়।”