muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

করিমগঞ্জ

বিমানবিধ্বংসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল : ১২ বছর বয়সী কিশোরের গুলিতে ভূপাতিত পাকিস্তানি বিমান

বিমানবিধ্বংসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল : ১২ বছর বয়সী কিশোরের গুলিতে ভূপাতিত পাকিস্তানি বিমান

১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের দিনগুলো স্মরণ করলেই এখনও শিহরিত হন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের টামনি নোয়াপাড়া গ্রামের মো. ইসমাইল। বয়স তখন মাত্র ১২। যুদ্ধের খবর শুনে আগুনের মতো জ্বলে ওঠা কিশোর মন, কিন্তু বয়স কম বলে প্রথমে কেউই তাকে যুদ্ধে নিতে চাননি। তিনি আজ পরিচিত ‘বিমানবিধ্বংসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইলের সাক্ষাতকার নিতে গেলে নিজের বর্ণিল ও রক্তঝরা যুদ্ধস্মৃতি শুনিয়ে তিনি বলেন, “২৬ মার্চ সন্ধ্যায় রেডিওতে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেই মনে হয়েছিল যেতে হবে। লড়তে হবে।”

১৯৭১ সালের ১০ মে বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার দিনটির স্মৃতি এখনও স্পষ্ট ইসমাইলের মনে। সমবয়সীদের সঙ্গে রাতের আঁধারে নদী-নালা পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যান ভারতের মেঘালয়ের ইকুয়ান ট্রেনিং সেন্টারে। বয়সের কারণে প্রশিক্ষণ পাওয়াটাই ছিল কঠিন। শেষ পর্যন্ত সব বাধা পেরিয়ে তিনি যোগ দেন ৫ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে।

প্রথম মুখোমুখি লড়াই ছিল টেংরাটিলা যুদ্ধে। এরপর তেলিখাল আর্মি ক্যাম্পে আক্রমণ, এবং প্রায় প্রতিরাতে পাকবাহিনীর অবস্থানে হিট-অ্যান্ড-রান হামলা। টানা এক সপ্তাহ হাওড়ে নৌকা চালিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকার কঠোর অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেন তিনি।

সিলেটের সালুটিকর বিমানবন্দর তখন পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র ও রসদের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকেন্দ্র। ইসমাইল বলেন, “একদিন গ্রামবাসী জানাল, পরিবহন বিমান নামবে। মাসে দু-একবার আসে। আমরা প্রস্তুত হতে সময় নিলাম না।”

উকলাঘর বনের ভেতর কৌশলগত পজিশন নেওয়া হলো। দুটি নৌকায় বাঁশের ওপর স্থাপন করা এলএমজি, মাঝখানে রাইফেলধারী চার যোদ্ধা; অন্যরা ৫০০ গজজুড়ে ছড়িয়ে। স্নায়ুচাপে অপেক্ষা। হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে শুরু হলো পরিবহন বিমানের শব্দ।

“বিমানটা এত নিচ দিয়ে গেল যে মনে হচ্ছিল এখনই হাত ছুঁয়ে যাব,” বলেন ইসমাইল। পরক্ষণেই গর্জে উঠল মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি। হাওড়ে যেন ঝড় উঠল। নৌকা দুলছিল, সবাই রক্তাক্ত ঝোপের খোঁচায়, কিন্তু চোখ ছিল আকাশে।

অবশেষে দেখা গেল বিমানের পেছন দিক থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আনন্দে গগনবিদারী জয়ধ্বনি। পাকিস্তানি বাহিনী আতঙ্কে অন্ধের মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে সালুটিকর ঘাঁটি থেকে। কিছুক্ষণ পর দক্ষিণ হাওড়পাড়ে নাক নিচু করে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে বিমানটি।

এই ঘটনাই পরদিন জয় বাংলা পত্রিকা ও আকাশবাণীতে ফলাও করে প্রচারিত হয়, এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার হাতে পাকিস্তানি পরিবহন বিমান ভূপাতিত।

দীর্ঘ সরকারি চাকরি শেষে আজ অবসরজীবনে আছেন ইসমাইল। ফিরে দেখেন যুদ্ধের স্বপ্ন, এবং ব্যথিত কণ্ঠে বলেন, “আমরা যে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম সেই স্বপ্ন তো আজও অপূর্ণ। স্বৈরাচার আর ফ্যাসিবাদ আমাদের অর্জনকে ক্ষতবিক্ষত করেছে বারবার। তবে জুলাই অভ্যূত্থানের পর আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখি একটি ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ।”

মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইলের গল্প শুধু ব্যক্তিগত সাহসের সাক্ষ্য নয়; এটি স্মরণ করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার ইতিহাস এখনও অসম্পূর্ণ, আর সেই ইতিহাসের ভরসা এক কিশোরের অদম্য মনোবল।

Tags: