মন্তোষ চক্রবর্তী, অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ
নদী বিধৌত হাওড় জনপদ অষ্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ জেলার উপজেলা। ভৌগলিক কারণে পশ্চাদপদ এই জনপদ ষড়ঋতুর বাংলাদেশের ভাটির রানী হিসাবেই পরিচিত। শিক্ষায় একটু পিছিয়ে থাকলেও এই জনপদের মানুষের দিনাতিপাত নেহাৎ মন্দ বলা যাবে না। প্রাথমিক শিক্ষার পর ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীরা এখানে অনেক বেশী। মাধ্যমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তায় আছে সদর ও আশে পাশের ইউনিয়নে ৫-৭ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তন্মধ্যে সেরা অষ্টগ্রাম সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শিক্ষকেরা স্বাধীনতার পূর্ব হতেই এ অঞ্চলের সাহিত্য, সাংস্কৃতি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, রাজনীতি কিংবা শিক্ষা প্রসারে রেখেছেন কার্যকরী ভূমিকা,এদের মাঝে যারা স্বীয় মহিমায় সারা অষ্টগ্রাম আলোকিত করে গেছেন এমনই দুইজন শিক্ষকের একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা স্বর্গীয় নির্মল চন্দ্র সাহা ও তাঁর স্ত্রী স্বর্গীয় হেনা রায়। স্বর্গীয় নির্মল চন্দ্র সাহা ১৯৬৯ সালে এই বিদ্যালয়ে যোগদান করেন পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, যুদ্ধকালীন সময়ে দুই ভাই একসাথে মুক্তিফৌজে যোগ দেয়ায় তাদের পৈতৃক ভিটা পুড়িয়ে দেয়া হয়। যুদ্ধ শেষে তিনি পুনরায় ওই বিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ন্যাপ কমিউনিস্টের রাজনীতি করার সুবাদে এ অঞ্চলের মজলুম জননেতা কাজী আব্দুল বারীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং এই পশ্চাদপদ অঞ্চলের ভালোবাসায় পুরো পরিবার নিয়েই এখানে থিতু হয়ে যান, ১৯৭৬ সালে বিয়ে করর পর তাঁর স্ত্রী স্বর্গীয় হেনা রায়ও ওই বিদ্যালয়ে যোগদান করেন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বাড়ি করেন বিদ্যালয়ের পাশেই যেটি এই অঞ্চলে “নির্মল স্যারের বাড়ী” নামেই পরিচিত। বিদ্যালয়ের পাশেই বাড়ী হওয়ায় সারাদিন ওই বাড়িতে থাকত ছাত্র-ছাত্রীদের আনাগোনা।দরিদ্র অবহেলিত শিক্ষা বঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের জন্য এই বাড়ীটিই ছিল একমাত্র অবলম্বন। ৪২ বছর শিক্ষকতার জীবণে অসংখ্য মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে শিক্ষা, শিক্ষার সরঞ্জামাদী কিংবা তাদের থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা হত এই বাড়িতেই।
ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের এই বাড়িতে নিয়ে এসে শিক্ষার ব্যাবস্থা করতেন এই শিক্ষক দম্পত্তি।বিদ্যালয়ে কোন শিক্ষার্থী অসুস্থ হলেও চিকিৎসাকালীন সময়টা এই বাড়িতেই থাকতেন শিক্ষার্থীরা।অষ্টগ্রামের শিক্ষা সাংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রই বলা হত বাড়ীটিকে।নিজেদের উপার্জনের সিংহ ভাগই আমৃত্যু এই দ্দম্পত্তি খরচ করেছেন সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষায়। শিক্ষকতার দীর্ঘ ৪২ বছর পেরোনো এই দম্পত্তির ছাত্রছাত্রী এই অঞ্চলের প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থীই এবং এদের সবাই এই দম্পত্তি তথা এই শিক্ষা-বাড়ীটির প্রতি অনুরক্ত। ৪২ বছর ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শেষে অবসরেও শিক্ষা প্রসারে থেমে ছিলেন না এই শিক্ষক দম্পত্তি,এই বাড়ীটিতেই নিজেদের ব্যাবস্থায় গড়ে তুলেন একটি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি শিক্ষা উন্নয়ন কেন্দ্র। শিক্ষার পাশাপাশি এই শিক্ষা উন্নয়ন কেন্দ্রে দারিদ্র শিক্ষার্থীরা থাকতেও পারতেন।বিদ্যালয়ের অবসর শেষেও থেমে ছিল না তাদের শিক্ষা কার্যক্রম। ২০১৪ সালের ১লা জুলাই ভারতের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরন করেন এই শিক্ষক দম্পত্তি। শেষ হয় এই পশ্চাদপদ অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারের একটি বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের। শোকে স্তম্ভিত হয় পুরো অষ্টগ্রামবাসী। এ অবস্থায় বাড়ী ফিরে আসে ঢাকায় থাকা তাদের একমাত্র পুত্র নবেন্দু নির্মল সাহা রাজীব, এসে হাল ধরেন প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়টির এবং নামকরন করেন “হেনা দিদিমনি’র পাঠশালা”।স্বীয় উদ্যোগে স্বল্প পরিসরে শুরু করেন এই বাড়ীটিতেই কলেজের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিষয়ে পাঠদানের শিক্ষা কেন্দ্র। এখন কলেজের প্রায় দুইশতেরও অধিক শিক্ষার্থী এই পাঠদান কেন্দ্রে প্রতিদিন পড়তে আসে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চলে এই পাঠদান। মাঝে চলে স্বর্গীয় নির্মল সাহা ও হেনা রায়ের প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান।প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে নবেন্দু নির্মল সাহা রাজীব খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে পাঠদান করেন অষ্টগ্রাম রোটারী ডিগ্রী কলেজে। এভাবেই এই অঞ্চলের শিক্ষা প্রসারে নীরবে নিভৃতে দাঁড়িয়ে আজোও এই শিক্ষাবাড়ীটি। এই অঞ্চলের মানুষের প্রিয় নির্মল স্যার ও হেনা দিদিমনি’র বাড়ী, এই অঞ্চলের শিক্ষাবাড়ী।
মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/২৫-১০-২০১৬ইং/ অর্থ