স্টাফ রিপোর্টারঃ
আবারও একদিনে দুই বাল্যবিবাহ দেয়ার প্রচেষ্ঠাকে প্রতিহত করলেন কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তরফদার মোঃ আক্তার জামীল। গোপন সূত্রে খরব পেয়ে গত ১৮ নভেম্বর ২০১৬ খ্রি. তারিখ শুক্রবার তিনি হানা দেন জেলার সদর ও পাকুন্দিয়া উপজেলার দু’টি বিয়ে বাড়িতে। সাধারণত: শুক্রবার মুসলিম সম্প্রদায়ের বিবাহ অনুষ্ঠান বেশী হয়ে থাকে। সকাল ১০.০০ টায় মুঠোফোনের অপর প্রান্ত হতে নাম পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়ে বাল্যবিবাহ আয়োজনের খবর আসে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তরফদার মো: আক্তার জামীলের কাছে।
মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে তাকে জানানো হয় সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের কাটাখালি গ্রামের মো: বকুলের ১৪ বছরের কন্যা তামান্নার সাথে একই উপজেলার রশিদাবাদ ইউনিয়নের সগড়া জামতলার আলালউদ্দিন এর ছেলে খাইরুল এর বিবাহের আয়োজন চলছে। সাথে সাথে তিনি খবর পাঠালেন থানায় সংশ্লিষ্ট স্থানে ফোর্স পাঠানোর জন্য। প্রস্তুত থাকতে বললেন বে সহকারীকে। খবর পৌঁছে গেল গণমাধ্যমের কর্মীদের নিকটও। এরপর সরকারি ছুটির দিন তিনি বেরিয়ে পড়লেন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের অভিযানে। পথিমধ্যে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যকে উপস্থিত থাকতে বললেন কনের বাড়িতে। একবার গাড়ীতে, আরেকবার দীঘর্, দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে বিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেখা গেল মহা ধুমধামে চলছে বিয়ের আয়োজন। একদিকে রান্নাবান্না, অন্যদিকে চলছে কনে সাজানোর কাজ।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তরফদার মো: আক্তার জামীল বিয়ে বাড়িতে পৌঁছানোর সাথে সাথে থেমে গেল সব আয়োজন। ডাকা হলো কনের অভিভাবকদের। আলোচনার ফাঁকে কনে জানালো এ অকাল বিয়েতে সে রাজী নয়। বিয়েতে কনের আপত্তির কথায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ উপস্থিত এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ জোর করে বিয়ে দেয়ার প্রচেষ্ঠায় কনের অভিভাবকদের উপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হলেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য বললেন, বয়স বাড়িয়ে একটি জন্ম সনদ নেয়ার জন্য গিয়েছিলেন মেয়ের অভিভাবক। কিন্তু তিনি বলেছেন এডিসি জেনারেল স্যার জানতে পারলে সমস্যা হবে। আর এ কাজটি আইন বহির্ভূত। তিনি এ ধরণের জন্ম সনদ দিবেন না। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তরফদার মো: আক্তার জামীল বন্ধ করতে বললেন বিধি বহির্ভূত এ বাল্য বিবাহ।
এদিকে এডিসি জেনারেলের আসার খবরে বরপক্ষও আর বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হয়নি। বাল্যবিবাহের আয়োজনের অপরাধে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ এর ধারা ৬ অনুযায়ী ভ্রাম্যমান আদালতে কনের পিতা মো: বকুল মিয়া এবং মাতা ঝরণা বেগম প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে সর্বমোট দুই হাজার টাকা জরিমানা করেন তিনি। উপস্থিত স্থানীয় লোকজন ও অভিভাবকগণও সম্মত হলেন বয়স ১৮ না হওয়া পর্যন্ত তারা মেয়েকে বিয়ে দেবেন না। অভিশপ্ত বাল্য বিবাহের ভয়াল থাবা হতে বেঁচে গেল তামান্নার জীবন।
উল্লেখ্য, সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের কাটাখালি গ্রামে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যখন এডিসি জেনারেল এর নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চলছিলো, তখন স্থানীয় এক দৈনিকের সম্পাদক জানান, তার উপজেলা পাকুন্দিয়ার চিলাকারা এলাকায় অবস্থিত চিলাকারা মাদ্রাসার ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী ১৫ বছরের আফরোজা আক্তারের বিয়ের আয়োজন চলছে। জুমআর নামাজের পর বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু যশোদল ইউনিয়নের কাটাখালি গ্রাম থেকে পাকুন্দিয়ার চিলাকারা গ্রামের দূরত্ব অনেক। একটিতে অভিযান শেষ করে আরেকটিতে অভিযান চালালে ফল নাও পাওয়া যেতে পারে। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে বিবাহ কার্যক্রম। এদিকে সঙ্গে থাকা টহল পুলিশকে এক উপজেলা হতে অন্য উপজেলায় যেতে হলে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। এমন অবস্থায় এডিসি জেনারেল ফোন করলেন জেলা আনসার কমান্ড্যান্টকে। বললেন পাকুন্দিয়ার চিলাকারাতে আনসার ব্যাটালিয়ানের কিছু সদস্যকে পাঠাতে। এরপর তিনি রওনা দিলেন চিলাকারার উদ্দেশ্যে।
জুমআর নামাজ আর আদায় করা হলো না। বিয়ে বাড়িতে পৌঁছে এখানেও দেখা গেল মহা ধুমধামে চলছে বিয়ের আয়োজন। রান্নাবান্না শেষ। হাজার খানেক লোকের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। খাওয়ার উদ্দেশ্যে অতিথিরা অনেকে যার যার মতো বসে পড়েছেন টেবিলে। এদিকে সঙ্গীয় সহকর্মীদের নিয়ে তিনি ঢুকে পড়লেন সেখানে। সাথে থাকা সাংবাদিকরা উপস্থিত লোকজনকে জানালেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তরফদার মো: আক্তার জামীল এসেছেন।
কনের মা-বাবা-অভিভাবকদের সাথে কথা বলবেন। সাথে সাথে পাল্টে গেল দৃশ্যপট। ছেলেপক্ষ এসেছিলো বরকে নিয়ে। জানতে পেরে বর গাড়ী হতে একজনের মোটর সাইকেলে উঠে দ্রুত পালালো। পড়ে গেল তার পায়ের স্যান্ডেল জোড়া। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তরফদার মো: আক্তার জামীল হাজার খানেক অতিথিদের সামনে ব্যাখ্যা করলেন বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর ও আইনী দিকসমূহ।
এখানেও কনে জানালো বিয়েতে তার অমতের কথা। সে পড়তে চায়। একজন আবার জানালো বর প্রবাসে থাকে। মেয়ে সুন্দরী হওয়ায় তাকে এখনই বিয়ে করতে চেয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তরফদার মো: আক্তার জামীল বন্ধ করতে বললেন এ বাল্য বিবাহ। একই সাথে বাল্যবিবাহের আয়োজনের অপরাধে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ এর ধারা ৬ অনুযায়ী ভ্রাম্যমান আদালতে কনের পিতা মো: আফতাব উদ্দিন এবং মাতা রাশিদা বেগম, ছেলের পিতা সোহরাব উদ্দিন এবং মামা জিল্লু প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে সর্বমোট চার হাজার টাকা জরিমানা করেন তিনি।
মেয়ের অভিভাবকগণ সম্মত হলেন বয়স ১৮ না হওয়া পর্যন্ত তারা মেয়েকে বিয়ে দেবেন না। এদিকে শীতের বেলায় পড়ন্ত বিকালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তরফদার মো: আক্তার জামীল একদিনে দু’টি বালিকার জীবন রক্ষা করে মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে যখন রওনা দিলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে তখনও তার দুপুরের লাঞ্চ হয়নি।
মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/২০-১১-২০১৬ইং/ অর্থ