হানানুল বান্নাঃ
কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সর্বশেষ জেলা সম্মেলন হয় ২০০৯ সালের ২৯শে নভেম্বর। কিন্তু কেন্দ্র থেকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হয় ২০১১ সালের ২রা জুলাই। নেতৃত্বের কোন্দলের কারণে বিভক্ত ও নিষ্ক্রিয় সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা কমিটি ঘোষণার পর কিছুটা গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। কিন্তু পদপদবি নিয়ে অসন্তোষ ও গ্রুপিংয়ের কারণে জেলা কমিটি কখনো এক হয়ে কাজ করতে পারেনি। বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে সীমিত পরিসরে চলেছে দলীয় কার্যক্রম। পরে লাগাতার হরতাল অবরোধের সময় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা-মোকদ্দমায় রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটি। ফলে দলীয় কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়। এছাড়া জেলা বিএনপির কোনো কার্যালয় না থাকায় দলের কাজকর্মে সেভাবে গতি আসেনি কখনো। কার্যালয়ের অভাবে ঘরোয়া আঙ্গিকে দলীয় কর্মকাণ্ড চলেছে নেতাদের চেম্বারে চেম্বারে। ফলে মাঠের রাজনীতিতে প্রায় অদৃশ্য হয়ে পড়ে দলটি। বিএনপি নেতৃত্ব এ জন্যে সরকারের দমনপীড়ন নীতিকে বরাবরই দায়ী করে আসছেন। এ অবস্থায় কেন্দ্রের নির্দেশে ২০১৪ সালে বিএনপিতে দল গোছানোর তৎপরতা শুরু হলেও তা থমকে যায়।
জানা গেছে, বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত বিএনপির সাত বছর পর জেলা সম্মেলন হচ্ছে। কোন্দলসহ মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত দলটির অচলাবস্থা কাটাতে সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে। সম্মেলনকে ঘিরে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীদের মাঝেও ফিরে এসছে চাঙাভাব। সম্মেলনের প্রস্তুতির পাশাপাশি নতুন কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে চলছে গ্রুপিং-লবিং। যাঁরা এলাকায় থেকে দলের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম, তাদেরই মূল পদগুলোতেই দেখতে চান নেতাকর্মীরা। বর্তমান কমিটির সভাপতিসহ কমপক্ষে শীর্ষস্থানীয় এক ডজন নেতা এলাকায় থাকেন না। কর্মীদের অভিযোগ, এসব ‘প্রবাসী’ নেতাদের কারণেই কিশোরগঞ্জে দল শক্তিশালী ভিত্তি পাচ্ছে না। কাজেই এবার তাঁদের বাদ দিয়ে কমিটি করতে হবে।
সর্বশেষ সম্মেলনে অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানকে সভাপতি, শরীফুল আলমকে সহসভাপতি ও মো. মাজহারুল ইসলামকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পদ-পদবি পেয়েও ১৫১ সদস্যের জেলা কমিটির অনেকেই ঘোষিত কমিটির বিরোধিতা করে নিষ্ক্রিয় ছিলেন।
২০১৪ সালের ১২ই মে জেলা কমিটি বর্ধিত সভা করে জেলার ১৩টি উপজেলা ও ৮টি পৌর কমিটি ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্যে এই ২১টি ইউনিটের কমিটিও বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। গত আড়াই বছর ধরে চেষ্টা-তদ্বিরের পর সম্মেলনকে সামনে রেখে কয়েকটির কমিটি গঠন করা গেলেও এখনো আহ্বায়ক কমিটি পর্যন্ত করা যায়নি গুরুত্বপূর্ণ কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা ও পৌর শাখার। এছাড়া পাকুন্দিয়া উপজেলা ও পৌর শাখা এবং হোসেনপুর উপজেলা ও পৌর শাখায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা গেলেও সেসব কমিটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। দলের এ অচলাবস্থা কাটাতে সাত বছর পর আবার জেলা বিএনপির সম্মেলন হতে যাচ্ছে। মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় দলের ত্রিবার্ষিক এই সম্মেলনকে ঘিরে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, জেলা বিএনপির সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। দলের পক্ষ থেকে সম্মেলনের জন্য প্রশাসনের কাছে শহরের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্টেডিয়াম, পুরাতন স্টেডিয়াম ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির হল বরাদ্দ চেয়ে গত ৩০শে অক্টোবর আবেদন করা হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই তিনটির ভেন্যুর কোনোটিতেই সম্মেলনের জন্য অনুমতি দেয়া হয়নি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত ১৭ই নভেম্বর ১১টি শর্ত দিয়ে জেলা শহরের বত্রিশ এলাকার ‘উৎসব কমিউনিটি সেন্টার’ অথবা গাইটাল এলাকার ‘অতিথি কমিউনিটি সেন্টার’-এ সম্মেলন অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়া হয়। অনুমতি পাওয়ার পর ‘অতিথি কমিউনিটি সেন্টার’ এ সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বিএনপির তরফ থেকে।
সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক এবং বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মো. শরীফুল আলম জানান, প্রশাসনের দেয়া শর্ত মেনেই তারা শান্তিপূর্ণভাবে অতিথি কমিউনিটি সেন্টারে সম্মেলন আয়োজনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। যদিও ভেন্যু হিসেবে পাওয়া সম্মেলনস্থলটিতে তাদের ২ হাজার ১২১ জন কাউন্সিলরেরই স্থান সংকুলান হবে না। বাধ্য হয়ে স্বল্প পরিসরেই তাদের সম্মেলন আয়োজন করতে হচ্ছে। এরপরও সম্মেলনে অন্তত ২০ হাজার নেতাকর্মীর সমাগম হবে বলে তারা ধারণা করছেন।
এদিকে সম্মেলনকে সামনে রেখে মূল নেতৃত্ব সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে সম্ভাব্য নেতৃত্বের মধ্যে বিরাজ করছে ‘নীরব উত্তাপ’। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্মেলন আসলেই দেখা যায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রকাশ্যে দৌড়ঝাঁপ। কেন্দ্র থেকে জেলা পর্যন্ত চলে জোর লবিং। এমনকি মিডিয়ায় প্রচার পাওয়ার জন্যও এক ধরনের তদবির চলতে থাকে। বিএনপি যখন রাজনৈতিক চাপে ছিল না, তখন বিএনপি নেতাদের মধ্যেও একই চিত্র দেখা যেত। বরং বেশিই দেখা যেত। কিন্তু এবারের জেলা সম্মেলনকে ঘিরে কেন্দ্রে লবিংয়ের কথা শোনা গেলেও স্থানীয়ভাবে সরগরম করা কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না মূল পদ প্রত্যাশী নেতাদের মধ্যে। আবার অনেকে দলের কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড কর্তৃক অতীত কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার বাবদ যথাযোগ্য পদ প্রত্যাশা করছেন। তবে সম্মেলন একেবারেই দোরগোড়ায় থাকায় এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে নানা জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই।
জেলা বিএনপির বর্তমান সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. ফজলুর রহমানকে দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়েছে। তিনি নিজে থেকেই জেলার দায়িত্ব আর নিচ্ছেন না, এমনটি জানিয়েছেন। সেই কারণে সভাপতি পদে নতুন মুখ আসছে, এটা নিশ্চিত। এখন পর্যন্ত সভাপতি পদে বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মো. শরীফুল আলম, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ মো. হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক ও সাবেক এমপি মো. মাসুদ হিলালী, জেলা বিএনপির বর্তমান সহসভাপতি সাবেক ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ মো. রেজাউল করিম খান চুন্নু, বর্তমান সহসভাপতি মো. আমিরুজ্জামান, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, জেলা যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম মোল্লার নাম আলোচিত হচ্ছে।
এছাড়া সাধারণ সম্পাদক হিসেবে জেলা কমিটির বর্তমান প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অসীম সরকার বাঁধন, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী ইসরাইল মিয়া ও জেলা যুবদলের আহ্বায়ক সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শরীফুল ইসলামের নাম শোনা যাচ্ছে। তবে সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী চার নেতাই নিজেদের প্রার্থিতা জানান দিয়ে নানা তৎপরতা চালিয়ে গেলেও সভাপতি পদে নাম আসা নেতাদের অধিকাংশই হাঁটছেন অন্যপথে। তারা ঘোষণা দিয়ে প্রার্থী হওয়ার বদলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের দোহাই দিচ্ছেন। তবে সাধারণ নেতাকর্মীরা বলছেন, সম্মেলনের মাধ্যমে তারা কোনো একতরফা কমিটি চান না। তারা চান নেতৃত্বের ঐক্য ও সংহতি। এমন নেতাদের কমিটিতে স্থান দিতে হবে যারা দলের বিভক্তি দূর করে দলকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারবেন। তা না হলে এখানে দলকে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার পথেই হাঁটতে হবে।
সম্মেলনে নেতৃত্ব নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে সম্মেলনে নতুন কমিটি গঠন করতে পারব বলে আশা রাখি।’
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, যে দুটি কমিউনিটি সেন্টারের কথা বলা হচ্ছে, এর মধ্যে উৎসব কমিউনিটি সেন্টার আগে থেকে বুকিং থাকায় পাওয়া যাচ্ছে না। সে কারণে অতিথি কমিউনিটি সেন্টারেই সম্মেলন করতে হচ্ছে। তিনি জানান, জেলা প্রশাসন থেকে সাতটি শর্ত দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যেখানে সম্মেলন হবে, তার বাইরে কোনো মাইক ব্যবহার করা যাবে না। সম্মেলন স্থলের কাছে একটির বেশি তোরণ নির্মাণ করা যাবে না। সম্মেলনে কর্মীরা মিছিল নিয়ে যোগ দিতে পারবে না। রাষ্ট্র বা সরকারবিরোধী কোনো বক্তব্য রাখা যাবে না। সরকারি সম্পত্তির কোনো ক্ষতি করা যাবে না, ক্ষতি করলে আয়োজকদের দায়দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি বলেন, এক গেট ও এক মাইক ব্যবহার করে সম্মেলন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তাদের।
এ ব্যাপারে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মাসউদ বলেন, দুটি স্টেডিয়ামেই উন্নয়নকাজ হচ্ছে, এ ছাড়া শিল্পকলা একাডেমিতেও কিছু সমস্যা আছে। এসব কারণে বিএনপিকে বিকল্প হিসেবে দুটি কমিউনিটি সেন্টারের যেকোনো একটিতে সম্মেলন করার কথা বলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, পুলিশ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই বিএনপির সম্মেলনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন।
জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রশাসন যতই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করুক না কেন, তারা সম্মেলন করবেই। ভেন্যু নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা আপাতত কেটে যাওয়াতে বিএনপির নেতাকর্মীদের চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রশাসন যা-ই বলুক উৎসবমুখর পরিবেশেই সম্মেলন হবে।
জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক অসীম সরকার বাঁধন বলেন, প্রশাসনের সবচেয়ে হাস্যকর শর্তটি হচ্ছে ‘সরকারবিরোধী কোনো বক্তব্য রাখা যাবে না।’ এখন বিরোধী দলকে যদি বলা হয় সরকারের কোনো সমালোচনা করা যাবে না, সেটা কেমন হয়। তার পরও আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সম্মেলনটি করার চেষ্টা করব।
জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সম্মেলনে প্রধান অতিথি থাকবেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উদ্বোধন করবেন যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান।