রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হচ্ছে। এ লক্ষ্যে গতকাল প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রের মূল পর্বের কাজ বাস্তবায়নে রাশিয়া ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা (১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার) ঋণ দেবে। সরকারি তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হবে ২২ হাজার ৫২ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গতকাল শেরে বাংলানগরস্থ এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর বিষয়ে সাংবাদিকদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরেন। এ সময় জানানো হয় ব্যয়ের দিক থেকে অনুমোদন পাওয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্পই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় ভিভিইআর-১২০০ (এইএস-২০০৬) রিএক্টরের দুইটি বিদ্যুত্ ইউনিটের সমন্বয়ে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট উত্পাদন ক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। বিদ্যুত্ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের ভৌত অবকাঠামো ও সুবিধাদি স্থাপন করা হবে। বিদ্যুত্ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য পরমাণু প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য ও দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলা হবে। সেইসঙ্গে কার্বনমুক্ত ও বেসলোড বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হবে। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইউনিটের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৬৯ জন এবং পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রের কমিশনিং, স্টার্ট আপ, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের ২৫৩৫ জন জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে। বিভিন্ন ধরনের ১০৬টি যানবাহন সংগ্রহ করা হবে।
গতকাল মোট ১২টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। বরাদ্দের দিক থেকে যা চলতি অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটের চেয়ে বেশি। পরিকল্পনা মন্ত্রী জানান, পাকিস্তান আমলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একটি করে পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন হলেও পূর্ব পাকিস্তানে হয়নি। পাকিস্তানে একে একে চারটি পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র হয়। কিন্তু আমাদের এখানে আর্থিক কারণে পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়নি।
তিনি আরো জানান, ২০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবে অর্থসহায়তা দিতে সম্মতি জানিয়েছিল রাশিয়া। ওই সময় ড. ওয়াজেদ মিয়াকে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এ উদ্যোগ আর এগোয়নি। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসলে পারমাণবিক বিদ্যুত্ প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া হয়। ধারাবাহিকভাবে অগ্রগতির পর চূড়ান্তভাবে পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে এ দেশে।
পরিকল্পনা মন্ত্রী জানান, বর্তমানে ৩৭টি দেশে ৬৭টি পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্র কার্যকর আছে। এ ধরনের বিদ্যুত্ কেন্দ্র স্থাপনে শুরুতে বেশি অর্থ প্রয়োজন হলেও দীর্ঘমেয়াদে বিবেচনায় উত্পাদন খরচ অনেক কম। ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুত্ কেন্দ্রে কয়লা কিনতে প্রতিবছর ব্যয় হয় ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রে একই সময়ে ব্যয় মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রটির আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ৬০ বছর। ফলে বিদ্যুত্ উত্পাদন খরচ অন্যান্য বিদ্যুত্ কেন্দ্রের তুলনায় কম হবে।
রাশিয়া ফেডারেশনের কাছ থেকে পাওয়া এ প্রকল্পের ঋণ ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ২০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। লাইবরের (লন্ডন আন্তঃ ব্যাংক লেনদেনের হার) সঙ্গে ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করে সুদ দিতে হবে। তবে সুদের হার ৪ শতাংশের বেশি হবে না।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বতর্মানে ৫ হাজার ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের প্রস্তুতিমূলক কাজ বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এতে ৪ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে রাশিয়া। ২০১৩ সালের এপ্রিলে প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে প্রস্তুতিমূলক কাজ বাস্তবায়নে রাশিয়ার ফেডারেশনের পক্ষে এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট এবং বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশনের মধ্যে ৪টি চুক্তি হয়। পারমাণবিক বিদ্যুত্ কেন্দ্রের মূল কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে। শেষ হওয়ার কথা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে।
গতকাল একনেকে অনুমোদিত অন্য প্রকল্পগুলো হলো, ২ হাজার ১০৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (ফেজ-১) (১ম সংশোধিত) প্রকল্প, ৩৭৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, ২১৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে জাতীয় ডাইজেস্টিভ ডিজিজেস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্প (১ম সংশোধিত), ২০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা ব্যয়ে ডিপিডিসি এলাকায় বিদ্যুত্ বিতরণ ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, ১ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন সমান্তরাল পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প, ১ হাজার ৮৭৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ (ভেড়ামারা)-ভারত(বহরমপুর) বিদ্যমান গ্রিড আন্তঃসংযোগের ক্ষমতা বর্ধিতকরণ (৫০০ মেগাওয়াট) প্রকল্প (১ম সংশোধিত), ৭৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে আনোয়ারা-ফৌজদারহাট গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন প্রকল্প, ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা রেলওয়ে সেতু নির্মাণ, ৭৩১ কোটি ৮৬ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে সমগ্র দেশে শহর ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস নির্মাণ প্রকল্প, ৬১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্প এবং ৭১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাসমূহের উন্নয়ন এবং নালা, প্রতিরোধ দেয়াল, ব্রিজ ও কালভার্ট এর নির্মাণ/পুনঃনির্মাণ প্রকল্প।
মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠ ডটকম/ ০৬- ১২-২০১৬ ইং / মো: হাছিব