নিকলী থেকে গুরুই যাতায়াত অনেকটা কষ্ট সাধ্য বিষয় প্রথমে গার্লসস্কুল মোড় থেকে অটো রিকসায় পাঁচরুখী মোড় পর্যন্ত। সেখান থেকে হাওরের মাঝখান দিয়ে খানাখন্দকে ভরা আভূরা সড়কে মোটর সাইকেল দিয়ে গুরুই মঠ ভাঙ্গা পর্যন্ত। গুরুই গিয়ে জানতে পারলাম তিনি ওখানে থাকেন না। তারপর সেখান থেকে রিকসা নিয়ে চললাম। গুরুইয়ের নদীর ওপারে বাজিতপুর উপজেলার হিলচিয়া গ্রাম। কিছুক্ষণ রিকসা চলতে লাগলো। এলাকার একজন বয়স্ক ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলে বাড়িটি দেখিয়ে দেন। রিকসা থেমে গেলো সড়কে। তারপর সরু একটি গলি ক্ষেতের আইল চলে গেলো। এই পথ দিয়ে হেঁটে গিয়ে দেখতে পেলাম দু চালা ছোট একটি ঘর। অল্প উঠোন। এরি মাঝে ছোট একটি খাট। কাঁথা বালিশ এলোমেলো। জীর্ণ শীর্ণ শরীরে শুয়ে রেডিওর অনুষ্ঠান শুনছেন একাত্তরের বীর সেনানি সকিনা। ভিটেমাটি হারিয়ে অন্যের বাড়িতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আরেক কন্যা বীরাঙ্গনা সকিনা! এখন বড় দুঃসময় যাচ্ছে। মা-বাবা ভাই- বোন নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এবার জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে ১৯৭৪ সালে ঢাকায় এলেন সকিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন। কেঁদে কেঁদে বললেন, “আমার মতিকে ফিরিয়ে দিন”। বোনের ছেলে মতিই ছিল তাদের পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান। সকিনা জানান, বঙ্গবন্ধু সে দিন সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন শেখ হাসিনা শেখ রেহানার মতো তুমিও আমার আরেক মেয়ে। তোমাকে দেখাশোনার দায়িত্ব আমার। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু তার স্বপরিবারে শহিদ হলে সকিনার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। বাবা শেখ মুজিবকে হারিয়ে বিভিষীকাময় পরিস্থিতির শিকার হন। সকিনার জন্ম কিশোরগন্জের নিকলী উপজেলার গুরুই গ্রামে। বয়স ৭৮। তার প্রকৃত বাবার নাম সোনাফর আলী। বীরাঙ্গনা সকিনা এখন বয়সের ভারে ন্যূব্জ হয়ে পড়েছেন। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেছে। কাউকে দেখে সহজে চিনতেও পারছেন না। গত ৩ মে মঙ্গলবার তার সাথে দেখা হলে তিনি এসব বলেন, ১৯৭১ সালে তার ভাগ্নে পাক বাহিনীর হাতে শহিদ হওয়ার পর নিকলীর রোদার পুড্ডাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টারে কমান্ডার কাশেমের কাছে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর একাধিকবার সশস্ত্র লড়াই করেছেন। তিনি একজন দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। যুদ্ধকালীন গোয়েন্দা তথ্যও সংগ্রহ করতেন জাতির এ সেরা সন্তান। তার গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা একাধিক অপারেশন সফল করেছেন। একবার গোপন তথ্য সরবরাহ করতে গিয়ে সরারচর রেলস্টেশনের কাছে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তার ওপর নির্যাতন হলেও মুখ খুলেননি। নিজেকে বিহারী বলে পরিচয় দেন এবং উর্দুতে কথা বলেন। সাহসীনী এই মুক্তিযোদ্ধা একাকী নিকলী উপজেলার ৫ জন রাজাকারকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। তার সেই দা এখন ঢাকার সেগুনবাগিচায় মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সেই দা-কে অবলম্বন করে গল্প লিখেছেন লেখিকা সেলিনা হোসেন। এই নারী মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য ২০০৭ সালে দি আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ‘উইমেন অব দি ইয়ার ২০০৭’ নির্বাচিত হন। হোষ্ট অব দি ওয়ার্ল্ড ফোরাম ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ ইংল্যান্ড কর্তৃক ২০১০ সালের শ্রেষ্ঠ বাংলাদেশী নারী নির্বাচিত হন। আর্থিক অভাব অনটনে থাকায় ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির সম্মাননা অনুষ্ঠানে যেতে পারেননি তিনি। বর্তমানে আর্থিক, শারিরীক অবস্থা খুবই খারাপ। পৈত্রিক ৩ শতক ভিটাতে কোনো ঘর না থাকায় ছোট একটি খুপড়ি ঘরে কোন রকমে দিন পার করছেন হিলচিয়ার জোবেদ আলীর স্ত্রী ফাইজুন্নেসার সাথে। ভূমিহীন কোটা ছেত্রার হাওরে ১ একর জমি থাকলেও সেটি প্রভাবশালীদের ভোগদখলে আছে। তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা যে ক’টা টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে চলে না। চিকিৎসা, খাবার যোগাতে বর্তমানে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকার মতো ঋণ হয়ে গেছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে শুধু একবার দেখা করতে চান। এজন্য অনেক চেষ্টা তদবির করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি জানান, ১৯৯৯ সালে একবার ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় দেখা করার অনুমতি পাননি। এবার শেষ চেষ্টা মৃত্যুর আগে একবার শেখ হাসিনার সাথে কথা বলতে চাই। তথ্য সংগ্রহে : মনিয়ারা বিথী
মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠ ডটকম/ ১৪- ১২-২০১৬ ইং / মো: হাছিব