বিনোদন রিপোর্টঃ
স্মৃতি বিজড়িত প্রতিটি মানুষের জীবন। কিছু স্মৃতি আনন্দের, কিছু স্মৃতি বেদনার। আবার কিছু স্মৃতি এই দু’য়ে জড়ানো। তেমনি এক স্মৃতির গল্প লিখেছেন ৮০ ও ৯০ দশকের তুমুল জনপ্রিয় সুরকার ও কম্পোজার, চাইম ও আর্ক ব্যান্ডের প্রতিষ্টাতা আশিকুজ্জামান টুলু। লেখাটি সংগ্রহ করেছেন জাতীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল “মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ” ডটকমের প্রতিবেদক রিয়াজ আহাম্মেদ সজীব।
টি গার্ডেনে প্রোগ্রাম । ১৬০০০ হাজার টাকা ঠিক হোল । একি যা তা কথা । ১৬০০০ টাকা । আসলে এই বাগান ওয়ালাদের টাকাও আছে এবং টাকা দেয়ার কলিজাও আছে । প্রচুর খরচ করে থারটি ফার্স্ট এর পার্টিতে । মনে পড়ে যায় – ছোট কালে যেতাম বন্ধু নাজনিনের বাসা ধানমণ্ডি ৭ নম্বরে ড্যান্সপার্টিতে । যেহেতু কো এডুকেশন এ পড়ালেখা করেছি, ছেলে বন্ধুদের সাথে মেয়ে বন্ধুও ছিল তবে দূর থেকে শুনে মনে হতে পারে কি আনন্দ, মেয়ে বন্ধুও আছে । কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এই প্রতিটা মেয়ে ক্লাসমেটরা আমাদের উপর খুব মাতব্বরি চালাতো এবং ভাবখানা এমন করতো যেনো আমরা ওদের ছোট ভাই । প্রেম প্রেম ভাব তো দুরের ব্যাপার সারাক্ষণ একটা ঝগড়া ঝগড়া ভাব থাকতো । তবে জুনিওর ক্লাসের মেয়েদের প্রতি একটা রোমান্টিক ভাব সব সময় মনে ঝুলেই থাকতো । একবার একটা সুন্দর মেয়ের কাছে অফারও পেলাম, দুই ক্লাস জুনিওর । কিন্তু আমার ক্লাসের ছেলে বন্ধুরা মেয়েটা মোটা বলে আমার সামনে সব সময় ওকে হিপোপটোমাস বলে বলে কিছুতেই প্রেমটা হতে দিলনা । আসলে এখন বুঝি ওই শালারা জেলাস হয়ে স্যাবোটাজ করেছিলো । আবার একদিকে ভাবি ভালই হয়েছে কারন ও এখন বিরাট শিল্পপতির বউ, টাকাও প্রচুর । এই শিল্পিপতির বউ হলে শুধু ভালবাসা দিয়েই পেট ভরতে হতো, ওই পরিমাণ টাকার মুখ দেখতে হতো না । তবে মেয়েটা ভীষণ সুইট ছিল, এখন অবশ্য অসম্ভব আলট্রা মডার্ন এবং অন্য লেভেলে ওর বিচরণ যেখানে আমি পথচারি ছাড়া কিছুই না । ওই সময় আমাকে দেখলেই এমন একটা ছলনা দিতো আমি একেবারে ফিউজ হয়ে যেতাম । কয়েক বছর আগে ধানমণ্ডি ৫ নম্বরে নিকর এর সামনে দেখেছিলাম । ও এবং ওর স্বামী, আমাকে দেখেই গাড়িটা ঠিক দোকানের সামনে রেখে ওর স্বামীকে আমাকে দেখিয়ে কি যেন বলছিলো । নিশ্চয়ই বলছিলো “এই লোকটা আমার পিছনে পিছনে অনেক ঘুরেছে কিন্তু আমি মোটেই পাত্তা দেই নাই” ।
মুল গল্পে আসি । প্রচণ্ড প্র্যাকটিস শুরু হয়ে গেলো থার্টি ফার্স্ট এর প্রোগ্রামের জন্য । আমাদের বেশি ইংরেজি গান তোলা ছিলোনা । আমাদের লিড গিটারিস্ট দুর্বল থাকায় ইচ্ছা থাকলেও অনেক গান তুলতে পারতাম না । তবুও যতগুলো সম্ভব তুলতে থাকলাম । মাইকেল জ্যাক্সন এর বিট ইট, বিলিজিন আমাদের খুব প্রিয় ছিল । ওগুলিও তুললাম । তবে বিট ইট এর লিড এ আইশা ক্যাচালটা লাইগা গেলো । আমাদের লিড গিটারিস্ট বাবুল এই লিড ক্যামনে তুলবো??? লে হালুয়া, গিটারিস্ট তো গিটারের তার ছিঁড়া ফালাইতাসে কিন্তু ভ্যান হ্যালেনের বাজানো লিড তো আর এতো সহজ না যে ডাইল ভাত খাইয়া মাথায় তেল দিয়া লিডটা উঠাইয়া ফালাইবো । প্রোগ্রামে গিয়া মানুষের চোখে ধোঁকা দিয়া keyboardist রে দিয়া লিড বাজায়া দিসিলাম । মোটামুটি তিরিশ পয়তিরিশ টা ইংরেজি গান তুলে ফেললাম । যেখানে প্র্যাকটিস কোরতাম ওই বাড়ির সামনে একটা হোটেল ছিল, সেখান থেকে ডালপুরি আর চা ছিল আমাদের ব্রেক টাইমের খাবার । দুপুর বা রাত হয়ে গেলে ভাতও ওখান থেকে মেরে দিতাম ডালগোস বা শুধু ডাল দিয়ে । সাথে কথায় কথায় সিগারেট তো আছেই । যতবার সিগারেট ততবার চা । চায়ের জন্য সিগারেট খেতাম না বরং সিগারেটের জন্নেই চা খাওয়া হতো । বন্ধুরা বলতো আমি খাবার খেতাম খুব স্পিড এ কিন্তু সিগারেট টা খেতাম খুব আয়েশে, আস্তে আস্তে । যেদিন সিগারেট ছেড়েছিলাম তার পর থেকে প্রায় এক সপ্তাহ মনে হয়েছিলো যে আমি ছ্যাক খেয়েছি, জীবন খুব অর্থহীন মনে হতো ।
প্রোগ্রামের দিন চলে এলো । কিযে এক আনন্দে ভরে থাকতো মনটা যা বলার মত নয় । ট্রেনে যাবো । সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছে গেলাম কমলাপুর ট্রেন স্টেশনে । কি আনন্দ । আমাদের লিড গিটারিস্ট ও ড্রামার খুব রেস্পন্সিবল ছিল, রোডিদের সাথে ওরা ধরাধরি করে সব উঠিয়ে দিলো ট্রেনে । গায়কের ভাবখানা ছিল সবসময় একটা বাংলা সিনেমার নায়কের মত । একটা না ছুই না ছুই ভাব । উনি কিছুই ধরতেন না, সারাক্ষণ মুখে স্নো পাউডার মেখে, শার্ট প্যান্ট পরে বাবু হয়ে থাকতেন । আর যা ধকল সব আমাদের উপর দিয়ে যেতো । আমরা যে বাসায় প্র্যাকটিস কোরতাম সেটা ছিল আমার এক বন্ধুর বাসা । ১৫০ বছরের পুরোনো বাসা । আমরা ওর বাসায় গিয়ে সবাই একটা কাজ সব সময় কোরতাম । ওর বাসার ঢোকার আগে একটা উঠোন ছিল এবং উঠোনের পাশেই ছিল একটা ড্রেন । আমরা যখনি যেতাম ওর বাসা সবাই দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব সময় প্রস্রাব কোরতাম ওই ড্রেনে তারপর ঢুকতাম বাসার ভেতরে । বন্ধু নিজেও তাই করতো এবং আমরা ওকে দেখেই শিখেছি । গায়কও রীতিমতো যতবার প্রয়োজন হতো ওই ড্রেনে গিয়ে মুত্র বিসর্জন করতো । একদিন গায়ক হটাত কি মনে করে আমাদের উপস্থিতিতে ওই ড্রেনের পাশে দাড়িয়ে আমার বন্ধুকে বলে উঠলোঃ
এখানে গন্ধ কিসের??
বন্ধু একটু রেগে গেলো এবং বললোঃ সারাদিন চনাও এখানে খাঁড়ায়া খাঁড়ায়া আর জানোনা গন্ধ কিসের????!!!!!
ফার্স্ট ক্লাস কুপ দেয়া হয়েছে তিনটা আমাদের আর আমাদের যন্ত্রপাতি ও রোডিদের জন্য দেয়া হয়েছে সেকেন্ড ক্লাসের এঁকোমোডেসন । উঠে পড়লাম ট্রেনে সন্ধ্যা নাগাদ । আঁটটা নাগাদ ছেড়ে দিলো ট্রেন । প্রচণ্ড ফাজলামি শুরু হয়ে গেলো সবার । যার যত মজার গল্প আছে সব বলা শুরু হয়ে গেলো । সবাই যে যার ড্রেস চেঞ্জ করে ইজি ড্রেস পরলো । রাত বাড়লো । সবাই মিলে ট্রেনের খাবার খেলাম পেট ভরে । সিগারেট ধরালো সবাই । লাইটটা নিভিয়ে দিলো ওরা । বাইরে চাদের আলো আর আমাদের ট্রেনের বগিতে ঘুঁট ঘুটে অন্ধকার, শুধু সিগারেটের আগুন গুলো নড়াচড়া করতে থাকে । একসময় সবার কথা থেমে যায়, ট্রেনের সাথে আমরাও ছুটে চলতে থাকি, একবুক আনন্দ নিয়ে, সিলেটের দিকে ।
রাত তিনটা নাগাদ পৌঁছে যাই শ্রীমঙ্গল । শ্রীমঙ্গল এ ট্রেন মাত্র পাঁচ মিনিট থামতো তাই খুব তাড়াতাড়ি করে সব যন্ত্রপাতি নামিয়ে নেয়া হোলো । স্টেশন এ চা বাগানের কয়েকজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আর বেশ কিছু বাগানের লোকজন আগে থেকেই উপস্থিত ছিল । ওরা ঝাপিয়ে পড়লো আমাদের সব কিছু ধরাধরির জন্য । জামাই আদর শুরু হয়ে গেলো । প্রচণ্ড যত্ন এবং আদরের মধ্যে দিয়ে শুরু হোল আমাদের প্রথম পর্ব । অন্ধকার স্টেশনের বাইরে দাঁড়ানো চার পাঁচটা গাড়ি তে গিয়ে উঠলাম আমরা সবাই । সামনে হেড লাইটের আলো খুব একটা বেশি দূরে যাচ্ছিলো না এবং যতটুকু দূর যাচ্ছিলো, শুধু ওই টুকুই দেখা যাচ্ছিলো । চারিদিকে শুধু ঝি ঝি পোকার আওয়াজ আর নিখাদ কালো অন্ধকার । আমাদের সবার ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু । ভীষণ ঠাণ্ডা তাই সবাই সোয়েটার আর জ্যাকেট পরে আছি । তবুও ঠাণ্ডাতে জমে যাওয়ার অবস্থা । ঢাকার চাইতে ওখানে অনেক বেশি ঠাণ্ডা । আধা ঘণ্টা ড্রাইভিং এর পরেই পৌঁছে গেলাম চা বাগানের বাংলোতে । বাংলোর বাবুর্চি মালি সবাই এসে ধরাধরি করে আমাদের সবকিছু উঠালো । সবার ঘর দেখিয়ে দিলো অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ভদ্রলোক । কিছু লাগলে কি করতে হবে সব বলে দিয়ে ওরা চলে গেলো । আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম ।
সুন্দর একটা সকাল হোলো, চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ, উচু নিচু টিলা আর আকাবাকা কাচা রাস্তা । সারা বাড়ি জুড়ে মাটির একটা সোঁদা সোঁদা গন্ধ । ঠাণ্ডা শিশির ভেজা সকাল । চারিদিকে নিস্তব্ধতা কানের মধ্যে কেমন একটা ঝি ঝি ধরিয়ে দিলো মনে হোল । বাবুর্চি টেবিলে নাস্তা দিলো । প্রচুর পরটা, ডিম মামলেট, মুরগির মাংশ আর চা দিয়ে নাস্তা সারলাম । কিছু বলার আগেই সব হাজির হয়ে যাচ্ছিলো । কি ভালো লাগছিলো । সবগুলি কর্মচারীগুলো হাফ প্যান্ট পরা, দৌড়ে দৌড়ে সব এনে দিচ্ছিলো । নাস্তা সেরে চলে গেলাম ক্লাবে যেখানে প্রোগ্রাম হবে । সব ইন্সট্রুমেনট সেট আপ করা হোল, আমরা সাউন্ড চেক করলাম । সব রেডি করে ফিরে আসলাম বাংলোতে । দুপুরে হাসের মাংস, গরুর ভুনা, মুরগির পাতলা ঝোলের তরকারী সাথে ঘন ডাল, সিলেটের সুগন্ধি গোঁড়া লেবু আর টমেটো শশা ধনে পাতা কাচা মরিচের সালাদ । প্রান খুলে এবং প্রচণ্ড পেট ভরে খেলাম । ঢাকার বাইরে গেলে ক্ষুধা লাগে বেশী । বিকালে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আমাদের নিয়ে সারা বাগান ঘুরিয়ে দেখালো । এক কার্টন সিগারেট দিয়ে গেলো ।
সন্ধ্যা হলো । আমরা রেডি হয়ে গেলাম । গাড়ি চলে আসলো । প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে অন্ধকার কাচা রাস্তা ধরে রওনা দিয়ে পৌঁছে গেলাম ক্লাবে । সরগরম ক্লাবঘর । প্রচুর লোকজনের সমাগম । সবার চোখে মুখে নতুন বছরের আনন্দের আলো ঝলমলো করছে । আমরা উঠে গেলাম স্টেজে । গিটার গুলো আবার টিউন চেক করে নিলাম এবং ওয়েট করতে থাকলাম অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের জন্য, ও বললেই শুরু করে দিবো ।
ওরা বললো শুরু করতে, আমরা শুরু করে দিলাম । সব ইংরেজি গান । তিন চারটা ইন্সট্রুমেনটাল রেডি ঙ্করা ছিল । একের পর এক বাজাতে শুরু কোরলাম । ধীরে ধীরে ড্যান্স ফ্লোরটা ভরে উঠলো কপোত কপতিতে । প্রথমে দুয়েকটা কিছুটা স্লো নাম্বার দিয়ে শুরু কোরলাম । জমে উঠলো অনুষ্ঠান । এভাবে প্রায় ১৫ টা গান হয়ে গেছে । ইতিমধ্যে আমরা ছোট দুটো ব্রেক নিয়ে নিয়েছি । অনুষ্ঠান ততক্ষণে মাঝপথে পৌঁছে গিয়েছে । সবাই নাচছে । ফ্লোরে তিল পরিমাণ জায়গা নেই । এর মধ্যে আমরা ফাস্ট রিদম এর গানগুলো শুরু করে দিয়েছি । হার্ড ড্রিঙ্ক এর তোড়ে অনেকের টালমাটাল অবস্থা । কিছু বাঙালি আছে যারা মদ পেলে খেয়ে মজা নেয়ার চাইতে “মদ খাচ্ছি” দেখিয়ে মজা পায় বেশী । ওখানেও বেশ কিছু “মদ খাচ্ছি” টাইপের লোক ছিল যাদের ড্যান্স দেখে মনে হচ্ছিলো ওনারা ড্যান্স না বরং হাডুডু খেলছেন । হটাত ফ্লোরে এক ভদ্রলোক আরেকজনকে কয়েক ঘা বসিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি ভিত্তিক ইংরেজিতে গালাগালি শুরু করে দিয়েছেন । একটা গণ্ডগোল লেগে গেলো । আমরা থামিয়ে দিলাম । বিস্রি একটা অবস্থার সূচনা হোল । এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে আরও ২০ মিনিট লেগে গেলো । আমরা আবার শুরু কোরলাম । চারিদিকে কেমন একটা চাপা উত্তেজনা । কেউ আর ফ্লোরে আসছেনা । নাচ থেমে গিয়েছে । আমরা একটার পর একটা নাম্বার বাজিয়ে চলেছি কিন্তু কোন কাজ হলনা । কেউ আর আগের মতো এগিয়ে এলোনা ফ্লোরে । আমাদের অসহায় লাগা শুরু হোল । আস্তে আস্তে আমরা নারভাস হওয়া শুরু কোরলাম । যেহেতু ক্লোজ ড্যান্সও হয় তাই কিছু স্লো গানও করছিলাম । কিন্তু কিযে হোল, কিছুই খাচ্ছিলো না । একে আমাদের সব গান শেষের পথে উপনিত হোলাম, বিটইট দুইবার গাইলাম । কিছু মানুষ আসলো ফ্লোরে, একটু নাচলো তারপর আবার চলে গেলো । ব্যাপক ফ্লোর ড্যান্স যেটা হয় সাধারণত, সেটা আর হলোনা । এক পর্যায়ে আমাদের গানের স্টক শেষ হয়ে গেলো তবুও আমরা ফ্লোর জমাতে পারলাম না ওই গ্যাঞ্জামটার পরে । বেশ কয়েকবার ব্রেক নিলাম, অন্য গান বাজালাম, তবুও কাজ হলোনা, বিধি বাম হয়ে গেলো । মনটা চুরমার হয়ে গেলো । আমরা কেউ কারো দিকে তাকাতে পারছিলাম না । ধিরে ধিরে দেখলাম ফ্লোর খালি হয়ে গেলো । শেষের অর্ধেক প্রোগ্রাম ভীষণ ফ্লপ করলো যেখানে আমাদের বিন্দুমাত্র কোন দোষ নেই । জানতে পারলাম যে কেউ একজন অন্য কারো বউয়ের সাথে জোর পূর্বক নাচতে গিয়েই শুরু হয়েছিলো ওই মুষ্টিযুদ্ধ । কিন্তু ওভাবে প্রোগ্রামটা একেবারে ধসে পড়ায় লজ্জায় দুঃখে চিৎকার করে কাদতে ইছছা করলো । অনুষ্ঠানের পরপরি একজন এসে বললেনঃ
আপনাদের প্রোগ্রাম ফ্লপ ।
আমরা চুপ করে থাকলাম । আরেকজন এসে বললেনঃ
এসব কি বাজাইলেন? কিছুইতো হইলো না, গতবার মাইলস আইসাতো ফাটায়া দিয়া গেসে । আপনারা রেডি হইয়া আশেন নাই?
মনে পড়ে গেলো আম্মার কথা । আম্মা মাঝে মাঝে আমার চাচাতো ভাইয়ের সাথে আমাকে কম্পেয়ার করে বলতেনঃ কি করলা তুমি, ওদিকে বাবু তো এপার্টমেন্ট কিনে ফেললো ।
যেকোনো মানুষকে অন্য কারো সাথে কম্পেয়ার করে কথা বললে খুব খারাপ লাগে, একেবারেই সহ্য করা যায় না ।
আমাদের ড্রামার আর পারলো না সহ্য করতে ; ও বলে উঠলোঃ
আমাগো আনসেন ক্যান, মাইলসরেই আনতেন । নিজেরা মিয়া অন্নের বউয়ের লগে নাইচা গ্যাঞ্জাম লাগায়া প্রোগ্রামের বারোটা বাজায়া আইসেন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে ।
লোকটা তেড়ে আসলো ড্রামারকে মারার জন্য, আমরা আটকালাম । ওর সাথে আরেকজন ছিল, ওকেতো কিছুতেই আটকানো যাচ্ছিলো না, ও মারবেই । ভীষণ হাতাহাতি শুরু হয়ে গেলো । ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার এসে পরিস্থিতি কন্ট্রোলে নিয়ে আসলেন । ভীষণ খারাপ লাগলো । মানুষ কিভাবে পারে নিজের দোষটাকে ভুলে গিয়ে অন্যকে দোষারোপ করতে । মনটা একেবারেই বিধ্বস্ত হয়ে গেলো ।
একসময় দেখলাম সারা ক্লাব খালি হয়ে গেছে, আর কেউ নাই । সবাই যে যার মত চলে গেছে । আমরা ক্লাবের বাইরে এসে সিগারেট ধরালাম । একটা গাড়িও নাই । আমাদের কে নিয়ে যাবে বাংলোতে তাও জানিনা । অনেক্ষন শুধু আমরা বসে রইলাম ক্লাবের দরজার কাছে । চারিদিকে অন্ধকার । আমরা ৬/৭ টা প্রানি ছাড়া আর কেউ নেই ক্লাবে । কারো মুখে কোন কথা নেই । সবাই আমরা নিশ্চুপ হয়ে গেছি, কারো আর কিছুই বলার নাই । আমরা সবাই গেটের কাছেই বসে আছি । কারো কোন প্রচেষ্টা বা তাড়া নেই বাংলোতে ফিরে যাওয়ার । প্রায় ঘণ্টা খানেক পর অন্ধকারের মধ্যে অনেক দূরে একটা হেড লাইট দেখলাম, মনে হোল ক্লাবের দিকে আসছে গাড়িটা । গাড়িটা এসে আমাদের নিয়ে বাংলোতে নামিয়ে দিলো । আমরা যে যার ঘরে ঢুকে পড়লাম । মালি দারয়ান বা বাবুর্চি কারো দেখা পেলাম না, হয়তো সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে । আমরাও না খেয়ে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে ঘুমিয়ে পোড়লাম ।
ঘুমাতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো বিধায় প্রায় দুপুরের দিকে উঠলাম সবাই । উঠে একটা জিনিস খেয়াল কোরলাম, বাংলোতে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই । এদিকে ক্ষুধায় আমাদের পাগল হওয়ার মতো অবস্থা । কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না । অপেক্ষা করতে থাকলাম । তিনটার টার দিকে বাবুর্চি এলো । আমরা ওকে খাবার দেয়ার কথা বললাম । ও বলল রান্না করেই খাবার দিয়ে দেবে । আমরা ওর কাছে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের খবর নিলাম, ও বলতে পারলো না উনি কোঁথায় । আরও ঘণ্টা খানেক পরে ও আমাদের খাবার দিলো । এবার খেতে দিলো ডাল ভাত আর ডিম ভাজি । আমরা প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ছিলাম, পাগলের মত খেয়ে ফেল্লাম । আশে পাশে শুধু জঙ্গল আর চা বাগান ছাড়া আর কিছুই ছিলোনা, কোন হোটেল থাকলে হয়তো ওখানে চলে যেতাম খাওয়ার জন্য । আমাদের খবর আর কেউ নিলোনা । ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের টিকিটাও খুজে পাওয়া গেলনা ।
রাতে ট্রেন । সন্ধ্যায় গাড়ি চলে এলো । আমরা ভগ্ন হৃদয় নিয়ে গাড়ীতে উঠে বোসলাম । এবার গাড়ী এসেছে মাত্র দুটো । এতগুলো মানুষ এবং সাথে যন্ত্রপাতি । কোনরকমে চাপাচাপি করে উঠে বোসলাম । খুব খারাপ লাগতে থাকলো । কেউ ছিলোনা আমাদের সি অফ করার জন্য । অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার একটা খবরও নিলো না আমাদের যার দায়িত্তে আমরা ছিলাম । আমরা স্টেশন পৌঁছে বসে রইলাম কারন ট্রেন আসবে সেই রাত এগারোটায় ।
ট্রেন এলো, আমরা উঠে বোসলাম । ট্রেন ছেড়ে দিলো দুটো হুইসেল দিয়ে । ধীরে ধীরে আলোকিত স্টেশনটা আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো । আমরা ডুবে গেলাম নিকশ কালো অন্ধকারে । শুধু ট্রেনের ঠাকা ঠাক ঠাকা ঠাক আওয়াজ ও সাথে এক বিশাদ নিরবতা । সবার কথা অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে । আমাদের কম্পারটমেনট এ কেউ আলো জ্বালায় নাই । ইচ্ছাও করলো না আর জ্বালাতে । মনে হোল আজ না হয় আধারেই থাকি । এ আর কি আধার, এর চেয়েও ঢের আধারে শিল্পীদের জীবন কাটে । একজন শিল্পী যে আসলে কত একা, তা সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানেনা । এই প্রজাতির মুখে হাসিটা দেখেই সবাই ভেবে নেয় এদের শুখের পরিমাণ, কেউ একবারের জন্নেও ভাবেনা কত ঘাত প্রতিঘাত অপমান সহ্য করে ভগ্ন প্রায় হৃদয় নিয়ে ভগ্ন প্রায় পায়ের ওপর নিজেকে দাড়িয়ে থাকতে হয় আর ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ওর সারা পরিবারটা । শিল্পীরা ততক্ষণই প্রয়োজনীয় যতক্ষণ কণ্ঠে সুর আছে, সুর না থাকলে কেউ পেছন ফিরেও দেখে না । প্রয়োজন শেষ হয়ে যাওয়ায় আজ অনেক শিল্পীই আধারে হারিয়ে গিয়েছে, কেউ মনেও রাখেনি যে একদিন এই মানুষটা তার সব সম্ভবনাকে বিসর্জন দিয়ে শুধু অন্যকে আনন্দ দেয়ার জন্নে ছুটে চলেছিলো পাগলের মত ।
মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/০১-০২-২০১৭ইং/ রিয়াজ আহাম্মেদ সজীব/ অর্থ