জান্নাতুল জাকির প্রিন্স ভূঁইয়া, পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) সংবাদদাতা :
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে গুরুতর অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। যাচাই-বাছাই শেষে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাতে উৎকোচের বিনিময়ে বিতর্কিতরা স্থান করে নিয়েছে। আর তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে মাঠের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের। পাকুন্দিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর মুঠোফোনের ধারণকৃত ঘুষ বাণিজ্যের কথোপকথনের অডিও রেকর্ডিংসহ উপজেলার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার দায়ের করা লিখিত অভিযোগ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
কথোপথনের রেকর্ডিং, লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ থেকে জানা যায়, পাকুন্দিয়া পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত মো. আমির উদ্দিনের পুত্র অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মো. আলমাছ উদ্দিন (৬১) তিনি মুক্তিযোদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এমএজি ওসমানি কর্তৃক সনদপ্রাপ্ত একজন মাঠের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকে যাচাই-বাছাইয়ে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ তিনি কর্ণেল আবু তাহের নেতৃত্বাধীন ১১নং সেক্টরের অধীন কোম্পানী কমান্ডার মো. শুকুর মাহমুদের নেতৃত্বে নান্দাইলসহ কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। তিনি বলেন, আমিসহ ১০/১২জন বাঙালী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে একসঙ্গে কটিয়াদীর ধুলদিয়া থেকে নদী পথে ভারতের মহেষখোলায় যাই, সেখান থেকে বাঘমারা ও ঢালু ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেই। যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে এ বিষয়ে যাবতীয় প্রমাণপত্র দাখিল করেছি। অথচ আমার মত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে তারা বাদ দিয়েছেন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমি টাকা দিতে পারিনি বলে আমার নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।
উপজেলার বাহাদিয়া গ্রামের মৃত আবদুল কাদিরের পুত্র ডা. মো. আবদুল খালেক(৬৪) তিনিও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এমএজি ওসমানি কর্তৃক সনদপ্রাপ্ত একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকেও যাচাই-বাছাই কমিটি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করেছেন। তিনিও কর্ণেল আবু তাহের নেতৃত্বাধীন ১১নং সেক্টরের অধীন কোম্পানী কমান্ডার মো. শুকুর মাহমুদের নেতৃত্বে সিলেটের তাহেরপুর, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া, কটিয়াদীর গচিহাটাসহ বিভিন্ন এলাকায় লড়াইয়ে অংশ নেন। তিনি জানান, তিনিসহ ১৫/২০জন লোক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে একসঙ্গে নিকলীর করগাঁও থেকে নৌকা যোগে প্রথমে বাংলা বাজার যান। সেখান থেকে ভারতের মহেষখোলা হয়ে বাঘমারা গিয়ে তুরা ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি যাচাই-বাছাই কমিটির কাছে সকল সাক্ষ্য প্রমাণপত্রসহ হাজির হই। কিন্তু দু:খের বিষয় ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ইউএনও অফিসে রাত ব্যাপি মিটিং হয়েছে। সেই মিটিংয়ের মাধ্যমে যাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েছে তাদের নাম তালিকায় রেখে ২৩ ফেব্রুয়ারি উপজেলা পরিষদের নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও উপজেলার মজিবুর রহমান, জসিম উদ্দিন, মোজাফফর হোসেন, আবুল হাশেমসহ আরও অনেকেরই প্রায় একই রকম অভিযোগ রয়েছে। তারা ক্ষোভের সঙ্গে জানান, তারা সাক্ষী ও প্রমাণপত্রসহ যাচাই-বাছাই কমিটিতে হাজির হয়েছেন কিন্তু তাদের প্রমাণপত্র গুলো কমিটি আমলেই নেয়নি। যারা টাকা দিয়েছে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে। অথচ তালিকায় অনেকেই অমুক্তিযোদ্ধা।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায় অনলাইনে আবেদন করেন ১৪শ ৮৬জন। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে ২৫জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কমিটি। তালিকা গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার উপজেলা পরিষদের নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দেয়া হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিতে সভাপতি ছিলেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের ডেপুটি কমান্ডার আবদুল মান্নান, কেন্দ্রিয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রতিনিধি মো. মির্জালী, জেলা কমান্ডারের প্রতিনিধি মো. হাফিজ উদ্দিন, উপজেলা কমান্ডার মো. মিছবাহ উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সদস্য মো. শাহাব উদ্দিন, জামুকা প্রতিনিধি ক্বারী আবদুর রাজ্জাক ও সদস্য সচিব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কবির উদ্দিন।
যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য ও জামুকা প্রতিনিধি ক্বারী আবদুর রাজ্জাক বলেন, আমি এবং ইউএনও স্যার দুজনে মিলে খুব চেষ্টা করেছি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় আনতে। কিন্তু বাকি ৫জন একদল হয়ে যাওয়ায় সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করতে পারিনি। উৎকোচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টাকা ছাড়া কি মনে করেন, অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধাকে অমুক্তিযোদ্ধা বানিয়েছে। আপনারা সঠিক ভাবে তদন্ত করলেই বিষয়টি পরিষ্কার ভাবে বেরিয়ে আসবে।
যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি জেলা ডেপুটি কমান্ডার আবদুল মান্নান বলেন, যাচাই-বাছাই কমিটি সঠিক নিয়ম কানুন মেনেই সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার মধ্য দিয়েই যাচাই-বাছাই করেছে। যারা বলে অনিয়ম হয়েছে তারা নিজেকে মানসিক শান্তনা দেয়ার জন্যই এ কথা বলছে। তাদের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।
সদস্য সচিব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কবির উদ্দীন বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে কোন অভিযোগ পাইনি। তবে কেউ যদি এ কথা বলে থাকেন তবে এর কোন ভিত্তি নেই। কেউ যদি বাদ পড়ে থাকেন তবে আপিলের সুযোগ রয়েছে। তিনি আপিল করতে পারবেন।
মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠ ডটকম/০৩-মার্চ-২০১৭ইং/নোমান