muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

জাতীয়

একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি

bongobondhu 1

সপরিবার হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সব আচারে নিষিদ্ধ ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাঠ্যপুস্তকে তাঁর নাম ছিলো খুবই গুরুত্বহীনভাবে। পাশাপাশি ছিলো ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসব। কিন্তু, নতুন প্রজন্মের মতো ইতিহাসবিদরাও বলছেন, সব বাধা অতিক্রম করে শেখ মুজিব আজ আরো বেশি দেদীপ্যমান, প্রতিদিন তার প্রত্যাবর্তনে আরো বেশি কণ্ঠে উচ্চারিত তাঁর নাম।

সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের সংগঠকরা বলছেন, আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আবারও সার্বজনীন রূপ পেয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর শাহাদাতের ৪০তম বার্ষিকীতে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় আরো বেশি শক্তিশালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ইতিহাস গবেষক ও শিক্ষাবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিরা যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত সব ধরণের বিষয়কে গোপন বা আড়াল করার চেষ্টা করেছে। তারা মনে করেছে, বঙ্গবন্ধুর কোনো কিছু ব্যবহার করলে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো বঙ্গবন্ধুর সব অর্জনও সার্বজনীন, সেজন্যইতো আমরা স্বাধীন দেশের মানুষ। তাঁর কোনো স্লোগান বা বঙ্গবন্ধু নিজেও কোনো দলের নন। তিনি সার্বজনীন।’

তবে নতুন করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে এমনটা মনে করেন না মুনতাসীর মামুন। তিনি বলেন, অপচেষ্টার অংশ হিসেবে অনেকে ইতিহাস বিকৃত করতে চেয়েছে। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সবকিছুকে একটি দলের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছে। কিন্তু তাতে কি শেষ অবধি তারা জয়ী হয়েছে?

‘বঙ্গবন্ধু বা তাঁর কোনো স্লোগান কখনো মানুষের মন থেকে সরে যেতে পারে না। তাই ফিরে আসার কথা আসবে কেনো? তিনি এবং জয় বাংলা স্লোগান সবসময় সবার মনে ছিলো। এখন মানুষ আবার ব্যবহার শুরু করেছে।’

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন: বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু হয়েছে, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাঁর বিরোধীরা। কিন্তু তাঁর আদর্শকে তো আর হত্যা করতে পারেনি। সেটা কখনো সম্ভবও না।

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন: বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধ সবসময় আমাদের হৃদয়ে ছিলো। এই দুটি না থাকলে তো আমরা ঠিকভাবে বাঙালিই হয়েও উঠতে পারবো না। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি শুধু কোনো দলকে প্রকাশ করে না। একটা সময় এই স্লোগানকে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি।

‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন সবাই এই একটি স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাত্মতা প্রকাশ করতো, আজও তেমনই। এই রাষ্ট্রের ভিত্তি ‘জয় বাংলা’, এই রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমান। যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে ততোদিন ‘জয় বাংলা’ থাকবে, ততোদিন বেঁচে থাকবেন বঙ্গবন্ধু।’

তিনি বলেন, শুরুতে আমরা যখন এই স্লোগান ব্যবহার করতাম তখন সবাই মনে করতো আমরা কোনো দলের হয়ে কথা বলছি। পরে ২০১৩ সালে এসে সেটা সবার জন্য সাধারণ স্লোগান হয়ে গেলো। এই স্লোগান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। এই স্লোগান এটাও মনে করিয়ে দেয়, এই রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিব, এই রাষ্ট্রের নেতা বঙ্গবন্ধু।

‘জয় বাংলার’ বীজ সবার মনে বপন হওয়াকে তিনি শেকড়ে ফেরা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, বলা যায় একটা ট্রেন যাত্রা শুরু করেছিলো। মাঝখানে সেটা লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিলো। নানান পথ ঘুরে এখন আবার সেটা নিজের জায়গায় ফেরত আসছে।

‘৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান পুরো বাংলাদেশের মানুষের সম্পদে পরিণত হয়। তাই বঙ্গবন্ধু আর ‘জয় বাংলা’ থেকে বাঙালিকে কখনো আলাদা করা সম্ভব না,’ বিশ্বাস ইমরান এইচ সরকারের।

প্রবীণ ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বললেন, এই স্লোগানটি আগে ব্যবহার করতো ছাত্র ইউনিয়ন। তবে ১৯৭১ সালে এই স্লোগান ব্যবহার শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অনেকে বলতেন ‘জয় হিন্দ’ এর অনুকরণেই ‘জয় বাংলা’ বানানো। আদতে সেটা নেওয়া হয়েছিলো কাজী নজরুল ইসলামের একটি প্রবন্ধ থেকে। সেখানে লেখা একটি বাক্য ‘বাঙালীর জয় হোক, বাংলার জয় হোক’ থেকেই এই স্লোগানটি উঠে এসেছে।

তবে এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় রয়েছে বলেই ‘জয় বাংলা’ ব্যবহারের অবরোধ কেটে গেছে বলে মনে করেন তিনি।

নতুন প্রজন্মও মনে করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ক্ষমতায় থাকার পথ ধরেই বঙ্গবন্ধু আজ অারো বেশি প্রতিষ্ঠিত।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আজফার হোসেন বলেন, আমাদের বেড়ে উঠার সময়ে শুরুতে তাঁকে সবকিছু থেকে আড়ালে রাখার চেষ্টা দেখেছি। কিন্তু পরে প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। সঙ্গে যতোই বাংলাদেশকে জানার চেষ্টা করেছি, যতোই আমাদের ইতিহাস পড়েছি, যতোই অতীত জানার চেষ্টা করেছি; ততোই বেশি উজ্জ্বল হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নাম।

তার মতোই বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নায়লা আমিন: আমাদের রাজনীতি আর আর রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে আমরা বিরক্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সবকিছুর উর্ধে। সেটা যে তাকে হত্যা করা হয়েছে, সেজন্য নয়। তিনি এখনো বেঁচে থাকলে অথবা তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও তিনি সবার উর্ধেই থাকতেন। কারণ এই যে আমি বাংলাদেশের নাগরিক সেটা কার জন্য? এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর জন্য।

‘শেকড়ের অনুসন্ধান করলেই বঙ্গবন্ধু অারো বেশি করে উপস্থিত হন,’ মন্তব্য করে নায়লা বলেন, আমাদের সেই শেকড়কে যারা মানতে পারেনি তারাই জাতির জনককে হত্যা করেছে, নৃশংসভাবে সপরিবার হত্যা করেছে। কিন্তু, নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর পুনর্জন্ম হয়েছে, বারবারই তিনি ফিরে ফিরে আসবেন, কারণ বাংলাদেশের আরেক নামই তো শেখ মুজিবুর রহমান।

তবে আজফার বা নায়লার মতো সবাই বড় হওয়ার বয়সে বঙ্গবন্ধুকে জানার মতো উপযুক্ত পরিবেশ পাননি। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরপর যে প্রজন্মের বেড়ে উঠা তারা বড় হয়েছে বিকৃত ইতিহাস জেনে।

সেই বিকৃতি অবশ্য স্থায়ী হতে পারেনি। যেমনটা বলছিলেন, বেসরকারি চাকুরিজীবী আব্দুল আউয়াল খান: আমরা যখন ফাইভ-সিক্সে পড়ি, তখন আমাদের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধুকে শুধু আড়াল করেই রাখা হয়নি, তাঁর সম্পর্কে অনেক মিথ্যা মিথও প্রচার করা হয়েছে।

তিনি বলেন: একটা সময় ছিলো অামরা সেই মিথকে বিশ্বাস করে বড় হয়েছি। কিন্তু যতোই পরিণত বয়সের দিকে যাচ্ছি, ততোই আরো বেশি করে বঙ্গবন্ধুকে উপলব্ধি করছি। যতোই বয়স হচ্ছে, ততোই আরো বেশি বুঝতে পারছি, আমাদের মানুষ ছিলেন একজনই। আমাদের আগের প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন, আমাদের পরের প্রজন্মের কাছেও আছেন। অার আমাদের প্রজন্মের কাছে প্রতিদিনই একটু একটু করে তাঁর প্রত্যাবর্তন হয়েছে। আমাদের সেই মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

Tags: