মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডেস্কঃ
প্রাণীজগতের মাঝে ‘হোমো সেপিয়েন্স’ একটি প্রজাতি। সকল প্রাণীর মধ্যে এ প্রজাতি শ্রেষ্ঠ। আর এ শ্রেষ্ঠত্ব তার মস্তিষ্কের কারণে। বড় মস্তিষ্কধারী (১৬০০সিসি) প্রাণী এটি। দ্বি-পদ, হস্ত, চক্ষু, কর্ণবিশিষ্ট এ প্রজাতির প্রাণিটি অসাধারণ তার সর্ববৃহৎ মগজের কারণে। স্নায়ুকোষ ও নিউরণ কোষের আধিক্যের কারণে। অন্যকোন প্রাণীর দেহটি এরচে’ বড় হতে পারে কিন্তু তাদের মগজ এত বড় নয়। সেই জীবজগতের মাঝে সৃষ্টির সেরা জীব হলো হোমো সেপিয়েন্স বা মানুষ। এ মানুষ-প্রজাতির মধ্যে সবচে’ সেরা মানুষ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক। এদেরকে এক কথায় প্রকাশ করলে যে শব্দটি চলে আসে তা হলো ‘শিক্ষক’। যিনি শিক্ষা দেন। যিনি জ্ঞান বিতরণ করেন। ‘শিক্ষা’ হলো এমন একটি বিষয় যা কেবল মানুষই গ্রহণ করতে পারে এবং তা থেকে মানুষ আচরণে অন্য প্রাণীরচে’ আলাদা হয়ে যায়। মানুষের আচরণ শাশ্বত কিংবা ধ্রুব নয়, পরিবর্তনশীল। মানুষের আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন মানেই শিক্ষা। এ শিক্ষার কারণেই মানুষ নিজে পরিবর্তিত হয় এবং সমাজকে পরিবর্তন করে এগিয়ে নেয়। শিক্ষার কারণেই মানুষ, মানবসমাজ, দেশ ও বিশ্ব এগিয়ে যায় প্রগতির রথে, সমুখপানে। প্রচলিত অর্থে আমরা যারা নিজেদেরকে শিক্ষক(?) দাবী করি, আমরা বেশিরভাগ হচ্ছি পথ-প্রদর্শক বা গাইড। সাহিত্যিক, কবি, লেখক, দার্শনিক, বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত বিষয়টি আমরা আত্মস্থ করি এবং তা ছাত্রদের কাছে উগ্ড়ে দেই। এখানে আমাদের নিজেদের কোন কৃতিত্ব নেই। সে অর্থে আমরা সকলেই নিজেদেরকে শিক্ষক দাবী করতে পারি না। তবে কেউ কেউ শিক্ষক, সকলেই নন। কারণ সকলেই আকাশের মতো বিশাল হৃদয়ের নয়, সকলেই সাগরের মতো অতল গভীর জ্ঞানের অধিকারী নয়। প্রকৃত শিক্ষক হিমালয়ের মতো খাড়া কিংবা শালপ্রাংশু ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ভয় দেখানো চোখ রাঙানীর কাছে দমিত নন। তুচ্ছ অনটনের কাছে ন্যূব্জ নন। প্রকৃত শিক্ষক আলোর দিশারী, আলোক বর্তিকা। অন্ধকার থেকে মানুষকে আলোর পথে নিয়ে আসেন।
যিনি শিক্ষক নাম ব্যবহার করে ছাত্রদেরকে অন্ধকার পথে নিয়ে যান তিনি শিক্ষক নামের কলঙ্ক। তিনি ছাত্রদেরকে আত্মকেন্দ্রিকতার শিক্ষা দেন, চিত্ত-বিকাশ নয়, বিত্ত-বৈভবের শিক্ষা দেন। তিনি শিক্ষক জাতির অভিশাপ। যিনি বাস্তব লৌকিক জগৎকে তুচ্ছ নশ্বর হিসেবে ছাত্রদের সামনে তুলে ধরে অলৌকিক অদৃশ্য জগৎকে একমাত্র মুক্তির ঠিকানা হিসেবে নির্দেশিত করেন এবং অভিযাত্রী তারুণ্যকে উগ্রতার পথে ঠেলে দেন, তিনি শিক্ষক হতে পারেন না। যিনি স্বদেশকে জননীর মতো ভালবাসতে পারেন না, তার শিক্ষক পরিচয় দেওয়ার কোন অধিকার নেই। যিনি বাঙলা ও বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসকে ধারণ করেন না, লালন করেন না, চর্চা করেন না, ক্লাসে ছাত্রদেরকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন না, তিনি শিক্ষক নন।
যিনি প্রকৌশলবিদ্যা পড়াবেন, যিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়াবেন, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, ভূগোল, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান পড়াবেন কিংবা যে কোন বিষয়ই পড়ান তাকে অবশ্যই আমাদের চর্যাপদ জানতে হবে। তাকে অবশ্যই কৈবর্তের ইতিহাস জানতে হবে। হাজার বছরে এই ব-দ্বীপে প্যাগোডা, মন্দির, গীর্জা, মসজিদের নির্বিরোধ গড়ে ওঠার সম্প্রীতির ইতিহাস জানতে হবে। তাকে অবশ্যই তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা জানতে হবে। তাকে অবশ্যই একান্ত আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রেখে আসা গৌরবদীপ্ত ত্যাগ-তীতীক্ষার কথা জানতে হবে এবং ছাত্রদেরকে তা জানাতে হবে। তার ছাত্রদেরকে জানাতে হবে আমাদের পূর্বপুরুষের গোলামীর ইতিহাস, বিদেশী বি-জাতীয় শোষণ নির্যাতনের ইতিহাস। শত-শত বছরের বিদ্রোহের ইতিহাস। অত:পর জানতে হবে এবং ছাত্রদেরকে জানাতে হবে শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে এক দুর্দান্ত দুর্বিনীত ঘোষণা এলো “আর আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না।” সেই রক্তমাখা ইতিহাসের লাল সুড়কি ঢালা পথ মাড়িয়ে একাত্তরে স্বাধীনতার সুবর্ণ বন্দরে বাঙালির তরী এসে নোঙর ফেললো। ক্লাসে যিনি এ বিষয়কে এড়িয়ে চলেন, তিনি যে বিষয়ের শিক্ষকই হোন না কেন প্রকৃত শিক্ষক নন। সেই শিক্ষকের ক্লাস থেকে তৈরি হয় উগ্র মতবাদে বিশ্বাসী জঙ্গী। সেই শিক্ষকই হলো জঙ্গী তৈরির কারিগর। আমরা মানব তৈরির কারিগর চাই, দানব তৈরির নয়।
অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী
সহ-সভাপতি
স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ (স্বাশিপ)
মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ ডটকম/২৯-০৩-২০১৭ইং/ অর্থ