সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়েছে।
এতে আদালত বলেছে, দণ্ডবিধির ৫৩ ধারা ও ৪৫ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে আমৃত্যু কারাবাস।
এর ফলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত সবাইকে আমৃত্যু কারাগারে থাকতে হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামিদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে এই রায়ের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র সচিব এবং কারা মহাপরিদর্শককে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলা হয়েছে, ‘দণ্ডের মেয়াদসমূহের ভগ্নাংশসমূহ হিসাব করার ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাবাসকে ৩০ বছর মেয়াদী কারাবাসের সমতুল্য বলে গণ্য হবে।’
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রায়ের পর আসামি পক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, তিনি প্রধান বিচারপতিকে বলেছিলেন যে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যেন আমৃত্যু কারাবাসের বিষয়ে মন্তব্য না থাকে।
“আমি বলেছি, প্রধান বিচারপতির এ মন্তব্য যেন মূল রায়ে না থাকে। যদি থাকে, তাহলে সব মামলার আসামিদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে।”
সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, আদালত বলেছে যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অর্থ ৩০ বছর নয়, বরং আমৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত জেলে থাকতে হবে।
“প্রধান বিচারপতি বলেছেন, রায়ে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হবে। উনার মতামত দেবেন যে আদালত যদি মনে করেন যে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হবে, তাহলে তাকে মৃত্যু অবধি জেলে থাকতে হবে।”
ব্রিটিশ আমলে করা আইন ও কারাবিধির বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরতে গিয়ে বিচারপতি এস কে সিনহা আদালতের বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে বিভ্রান্তির কথা বলে আসছিলেন।
গত বছরের ২৬ জুন গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বলতে আপনারা মনে করেন ৩০ বছর। ধরে নেয়, সব জায়গায়। প্রকৃত পক্ষে এটার অপব্যাখ্যা হচ্ছে। যাবজ্জীবন অর্থ হল একেবারে যাবজ্জীবন, রেস্ট অফ দ্য লাইফ।”
এরপর আদালতে দেওয়া রায়েও একই মত প্রকাশ করেন তিনি।
আদালত তার অভিমতে বলেছে, দণ্ডবিধির ৫৩ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের অর্থ ৪৫ ধারার সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে। সেক্ষেত্রে দেখা যায় যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু কারাদণ্ড।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সোমবার রাতে বলেন, আদালত তো এখানে নতুন আইন করছে না। আইনের একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছে। এই আইনটা যদি এতদিন সবাই না বুঝে থাকে, এখন আদালত যে ব্যাখ্যা দেয় সেটা মানতে হবে।”
“এখন যারা জেলে আছে, সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য হবে,” বলেন তিনি।
তবে তিনি একইসঙ্গে বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় ভালোভাবে পড়ে এবিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
“এর মধ্যে কেউ বের হয়ে গিয়ে থাকলে তাকে তো আবার জেলে ঢোকানো যাবে না। তবে সর্বোচ্চ আদালতের ব্যাখ্যা মানতে হবে।”
কারাবিধিতে আসামি রেয়াত পেলে দণ্ড আরও কমে আসে। কিন্তু আমৃত্যু সাজা হলে রেয়াত খাটবে না।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “সাধারণ কয়েদিদের ক্ষেত্রে তো আবার জেল কোড প্রযোজ্য। সেখানে যদি কেউ রেয়াত পায়, সেটার কী হবে- সেটা পুরো রায় পড়ে বুঝতে হবে।”
রায়ের পর্যবেক্ষণে সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, দণ্ডবিধির ৫৭ ধারা সেখানেই প্রযোজ্য হবে, যেখানে সর্বোচ্চ দণ্ড হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের বিধান যদি করা না হয়, তখন সাজার ভগ্নাংশ গণনা করাটা অসম্ভব হয়ে পড়বে। সাজা কমানোর (রেয়াত প্রদান) ক্ষেত্রে কারবিধি প্রশাসনিক আদেশ হিসেবে বিবেচিত।
২০০১ সালে গাজীপুরে জামান নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যার মামলার চূড়ান্ত রায়ে সর্বোচ্চ আদালতের এই পর্যবেক্ষণ আসে।
ওই ঘটনায় নিহতের বাবা সিরাজুল ইসলাম গাজীপুর মডেল থানায় এই হত্যা মামলা দায়ের করেন।
দ্রুত বিচার আদালত ২০০৩ সালে এ মামলার রায়ে তিন আসামি আনোয়ার হোসেন, আতাউর রহমান ও কামরুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। হাই কোর্টেও সর্বোচ্চ সাজার রায় বহাল থাকে।
এরপর আসামি আনোয়ার ও আতাউর সাজা কমানোর জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করেন। কামরুল পলাতক থাকায় আপিলের সুযোগ পাননি।
দুই আসামির আপিল শুনানি করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয় আপিল বিভাগ, যা আমৃত্যু কারাবাস হিসেবে গণ্য হবে।