আনিস মিয়া, ময়মনসিংহঃ
বয়োবৃদ্ধ মায়ের প্রতি সন্তানদের নিরবিচ্ছিন্ন অবহেলা, সন্তানদের দ্বারা শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন, শালিস বৈঠক বসিয়ে সকলের সামনে বৃদ্ধা মাকে অপমান অপদস্থ করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার অপচেষ্টা, ঘুমের মধ্যে বালিশ দিয়ে হত্যার হুমকী সহ্য করতে না পেরে ভয়ে অবশেষে বৃদ্ধা মা বেচেঁ থাকার দাবী নিয়ে আইনী আশ্রয়ের জন্য সন্তানদের বিরুদ্ধে থানায় সাধারন ডায়রি করেন।
অতঃপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে ন্যায় বিচারের প্রত্যাশায় বিজ্ঞ আদালতের স্মরনাপন্ন হন। অদ্য ১১/৬/১৭ তারিখে “ময়মনসিংহের বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ১ নং আমলি আদালত”, বাদী পক্ষে ড. আব্দুল্লাহ্ আল বাকী (এ্যাডভোকেট সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশ) সাহেবের শুনানীঅন্তে “৪০৮/২০১৭” নালিশী মামলাটি আমলে নেন এবং তিন জন বিবাদীর প্রতি সমন জারি করেন। মামলার অন্যান্য আইনজীবীরা ছিলেন এ্যাডভোকেট শহীদুল্লাহ সিরাজ, এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মোঃ মাহমুদুল হাসান(শিক্ষানবীশ আইনজীবী)।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা “সিরাজ প্রামানিক” সাহেব তাঁর আইনী বিশ্লেষনে লিখেছেন- “সন্তান জন্ম দান ও লালন-পালনকারী পিতা-মাতা বৃদ্ধ বয়সে যাতে সন্তান কর্তৃক অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার না হন সে জন্য পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ পাস হয়। বাবা-মা যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব কার উপর অর্পিত হবে এ আইনে সে সম্পর্কিত সুষ্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। কোনো সন্তান যদি যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণে পিতা-মাতার ভরণপোষণ না করেন, তাহলে তাঁরা এ আইনের অধীনে ভরণ-পোষণের জন্য আইনের আশ্রয় নিয়ে তাদের অধিকার আদায় করতে পারেন। আইনে ভরণপোষণ প্রদানে সন্তান বলতে শুধু পুত্রকেই বোঝায়নি বরং কন্যাকেও বুঝিয়েছে। অর্থাৎ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব শুধু ছেলের একার নয় বরং মেয়েকেও নিতে হবে। এর মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা আনা হয়েছে। আর ভরণপোষণ শুধু কোনো বিশেষ সন্তান নেবে তা নয় বরং সবাইকে নিতে হবে। তবে একাধিক সন্তান থাকলে তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাদের পিতা-মাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করবে। প্রত্যেক সন্তানকেই তাদের পিতা-মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে এবং চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হবে। পিতা-মাতা একত্রে বা আলাদা বসবাস করলে প্রত্যেক সন্তানকে সাধ্যমতো তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে। পিতা-মাতা যদি সন্তানের সঙ্গে বসবাস না করেন তবে তাদের প্রত্যেক সন্তান নিজ নিজ উপার্জন থেকে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ প্রদান করবে। আইনটি শুধু পিতা-মাতার ভরণপোষণ বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পিতা-মাতার অবর্তমানে দাদা-দাদি ও নানা-নানির ভরণপোষণ বিষয়েও জোর দিয়েছে। পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদিকে এবং মাতার অবর্তমানে নানা-নানিকে পিতা-মাতার মতো ভরণপোষণ দিতে হবে।
আইনটি সন্তানদের বিভিন্ন দায়িত্ব দেয়ার পাশাপাশি অপরাধ, দন্ড ও বিচারব্যবস্থা কেমন হবে সে বিষয়েও বিধান দিয়েছে। কেউ যদি এই বিধানাবলি লঙ্ঘন করে তবে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড হতে পারে। অনাদায়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদন্ড প্রদান করতে পারে আদালত। এছাড়া কোনো সন্তানের স্ত্রী বা স্বামী কিংবা পুত্র-কন্যা বা অন্য কোনো নিকটাত্মীয় যদি পিতা-মাতা বা দাদা-দাদি বা নানা-নানির ভরণপোষণ প্রদানে বাধা দেয় বা অসহযোগিতা করে তবে তার সাজাও উপরোল্লিখিত দন্ডের মতোই হবে। মামলায় আপস-মীমাংসারও সুযোগ রয়েছে।
” সিঙ্গাপুরে ১৯৯৫ সালে ‘মেইনটেইন্যান্স অব প্যারেন্ট এ্যাক্ট’ প্রণীত হয় এবং ১ জুন ১৯৯৬ সালে এ আইন কার্যকর হয়। ভারতে মেইনটেইন্যান্স এন্ড ওয়েলফেয়ার অব প্যারেন্ট এন্ড সিনিয়র সিটিজেনস এ্যাক্ট ২০০৭ সালে প্রণীত হয় এবং জম্মু ও কাশ্মীর ব্যাতিত সকল রাজ্যে এ আইন বলবৎ হয়। ২০১৩ সালের ১ জুলাই চীনে এরকম একটি আইন পাস হয়। ‘এলডারলি রাইটস ল’ বা প্রবীণ অধিকার আইন নামের সেই আইনটির মূলকথা, সন্তানদের অবশ্যই বৃদ্ধ বাবা-মার দেখাশোনা করতে হবে। এ আইনের অধীনে বাংলাদেশে প্রথম মামলা দায়ের করা হয় চাঁদপুর জেলায়। মা-বাবা’র ভরণ-পোষণ আইনের মামলায় কক্সবাজারে প্রথম ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৭ এপ্রিল ফরিদপুর জেলায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠ ডটকম/১১-০৬-২০১৭ইং/ অর্থ
Tags: