স্পোর্টস রিপোর্ট : পুঁজিটাই ছিল কম। বিস্ফোরক সব ব্যাটসম্যানে ঠাসা ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপের বিপক্ষে ২৬৪ রানের পুঁজি মোটেই বড় নয়। এই রান নিয়ে ম্যাচ জিততে হলে মুস্তাফিজুর রহমান, তাসকিন আহমেদ, সাকিব আল হাসানদের অসাধারণ কিছুই করে দেখাতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশের বোলাররা ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারল না। তাতে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা থামল সেমিফাইনালে। এজবাস্টনে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে বাংলাদেশকে ৯ উইকেটে হারিয়ে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ভারত উঠেছে ফাইনালে। যেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে পাকিস্তান। ১৮ জুন ঐতিহাসিক ওভালে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে মুখোমুখি হবে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-পাকিস্তান।
ম্যাচের গল্পটা অন্যরকমও হতে পারত। ৩১ রানে ২ উইকেট হারানোর পর তৃতীয় উইকেটে তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমের ১৩৩ রানের জুটি বাংলাদেশকে দিচ্ছিল তিনশ ছাড়ানো সংগ্রহের হাতছানি। ৩৩০ কিংবা ৩৪০ অনায়াসে হবে বলেই মনে হচ্ছিল তখন। কিন্তু এ জুটি ভাঙার পরই মুখ থুবড়ে পড়েছে বাংলাদেশের ব্যাটিং। একটা সময় তো আড়াইশ নিয়েই টানাটানি, জেঁকে বসেছিল অলআউট হওয়ার শঙ্কাও। শেষ দিকে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার ব্যাটে সেই শঙ্কা দূর হলেও সংগ্রহটা বড় হয়নি।
তবুও যা একটু লড়াইয়ের আশা দেখছিল ক্রিকেটপ্রেমীরা, সেটি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন ভারতের তিন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান ও বিরাট কোহলি। ২০১৫ সালে নিজের অভিষেক সিরিজে এই ভারতকে বলতে গেলে একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। ওই সিরিজের পর দুই দলের এটিই প্রথম ওয়ানডে। আজও মুস্তাফিজের কাছ থেকে অন্যরকম কিছুর প্রত্যাশায় ছিল অনেকে। কিন্তু ভারত যেন মুস্তাফিজকে ‘টার্গেট’ করে রেখেছিল আগেই থেকেই! বাঁহাতি পেসারের প্রথম দুই ওভার থেকেই ২১ রান তোলেন রোহিত ও ধাওয়ান। পরের কয়েক ওভারে মুস্তাফিজকে আর বোলিংয়েই আনেননি মাশরাফি।
রোহিত-ধাওয়ানের ৮৭ রানের উদ্বোধনী জুটিই কার্যত বাংলাদেশের লড়াইয়ের আশায় জল ঢেলে দেয়। সতীর্থ বোলারদের দুই হাতে রান বিলিয়ে দেওয়ার মাঝেও নিয়ন্ত্রিত বোলিং করা মাশরাফি ধাওয়ানকে মোসাদ্দেকের ক্যাচ বানিয়ে ভাঙেন জুটি। প্রথম তিন ম্যাচে পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলা ধাওয়ান এদিন করেছেন ৪৬। ধাওয়ানকে ফিরিয়েও স্বস্তিতে ছিল না বাংলাদেশ। বরং অধিনায়ক কোহলি ও রোহিত মিলে রুবেল-মুস্তাফিজদের চোখের জল নাকের জল এক করে ছাড়েন।
প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে নার্ভাস নাইন্টিজের শিকার রোহিত এদিন আর ভুল করেননি। ডানহাতি ব্যাটসম্যান মুস্তাফিজকে ছক্কা হাঁকিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছেন ১১১ বলে। ততক্ষণে কোহলিও তুলে নিয়েছেন টানা দ্বিতীয় ফিফটি। ভারতীয় অধিনায়ক গড়েছেন দ্রুততম ৮ হাজার রানের রেকর্ড। ১৭৫তম ইনিংসে ৮ হাজার রান পূর্ণ করলেন কোহলি। আগের রেকর্ড ছিল এবি ডি ভিলিয়ার্সের ১৮২ ইনিংস।
শেষ দিকে মনে হচ্ছিল, কোহলিও বুঝি সেঞ্চুরি করে ফেলেন! জয়ের জন্য যখন ভারতের চাই ৪, তখন ৯২ রান নিয়ে স্ট্রাইকে কোহলি। দুই রান নেওয়ার পর ছক্কা হাঁকালেই সেঞ্চুরি। তবে ৪১তম ওভারে সাব্বিরের প্রথম বলে চার হাঁকিয়ে ভারতীয় অধিনায়ক দলের জয় নিশ্চিত করেছেন অপরাজিত থেকেছেন ৯৬ রানে। ভারত ম্যাচ জিতেছে ৫৯ বল বাকি থাকতেই! রোহিত-কোহলির অবিচ্ছিন্ন দ্বিতীয় উইকেট জুটি ১৭৮ রানের। রোহিত ১২৯ বলে ১৫ চার ও এক ছক্কায় অপরাজিত ১২৩ রানে।
এর আগে টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক কোহলি। বৃষ্টির কারণে নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট পর শুরু হয় ম্যাচ। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে ফ্লাড লাইটগুলো জ্বলে ওঠে সাত-সকালেই। আকাশের মতো বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের শুরুটাও হয় আঁধারে।
আগের দুই ম্যাচে দুই অঙ্ক ছুঁতে ব্যর্থ সৌম্য সরকার আরেকবার হতাশ করেছেন। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান প্রথম ওভারেই ভুবনেশ্বর কুমারের অফ স্টাম্পের বাইরের বল ভেতরে টেনে প্লেড-অন হয়েছেন। তার নামের পাশে শূন্য, বাংলাদেশের সংগ্রহ তখন ১ উইকেটে ১ রান!
তিনে নেমে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে শুরুর ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করছিলেন সাব্বির রহমান। অন্যপাশে তামিম ইকবাল ছিলেন সতর্ক। কিন্তু টানা ১৩ বল ডট যাওয়ার পরই যেন ধৈর্য হারালেন সাব্বির। ভুবনেশ্বরের অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বল কাট করতে গিয়ে সাব্বির (২১ বলে ১৯) ক্যাচ দিলেন ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে রবীন্দ্র জাদেজাকে। ৩১ রানে ২ উইকেট হারিয়ে তখন চাপে বাংলাদেশ।
এরপর দলকে এগিয়ে নিয়েছেন তামিম ও মুশফিক। তামিম যদিও ফিরতে পারতেন ব্যক্তিগত ১৭ রানেই। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হার্দিক পান্ডিয়ার বলে প্লেড-অন হয়েছিলেন, কিন্তু পান্ডিয়ার বলটা ছিল নো! জীবন পেয়ে সেটি কাজে লাগিয়েছেন তামিম। তুলে নিয়েছেন ফিফটি। ১৯তম ওভারের শেষ বলে জাদেজাকে চার হাঁকিয়ে তামিম ফিফটি পূর্ণ করেছেন ৬২ বলে। তার ওই বাউন্ডারিতে পেরিয়েছে দলের শতরানও।
মুশফিক শুরু থেকেই খেলেছেন দেখেশুনে। রানের খাতা খুলেছেন ভুবনেশ্বরকে টানা তিন চার হাঁকিয়ে। পরে ফিফটি পূর্ণ করেছেন ৬১ বলে। ২৭ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান ২ উইকেটে ১৫২, তামিম-মুশফিকের তৃতীয় উইকেট জুটিও পেরিয়েছে শতরান। তখন মনে হচ্ছিল, অনায়াসেই তিনশ করে ফেলবে বাংলাদেশ। কিন্তু হিসাবটা পাল্টে যেতে সময় লাগেনি!
পরের ওভারেই অফ স্পিনার কেদার যাদবের বলে বোল্ড হয়ে ফিরেছেন তামিম (৭০)। তার ৮২ বলের ইনিংসে চার ৭টি, ছক্কা একটি। পাঁচে নামা সাকিব আল হাসান উইকেটে থিতু হয়েও ইনিংস বড় করতে পারেননি। জাদেজার বলে মহেন্দ্র সিং ধোনির ক্যাচ হওয়ার আগে সাকিব করেছেন ২৩ বলে ১৫। পরের ওভারে যাদবের বলে কোহলিকে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন মুশফিকও (৮৫ বলে ৬১)। ২ উইকেটে ১৫৪ থেকে বাংলাদেশের স্কোর তখন ৫ উইকেটে ১৭৯!
দ্রুত তিন উইকেট হারিয়ে চাপে পড়া দলকে টেনেছেন মাহমুদউল্লাহ ও মোসাদ্দেক হোসেন। দুজনের ব্যাটে বাংলাদেশ পেরিয়েছে দুইশ। দুজনের ৩৪ রানের জুটিটাও বেশ জমে উঠেছিল। কিন্তু জাসপ্রীত বুমরাহর বাউন্সার পুল করতে গিয়ে বল আকাশে তুলেছেন মোসাদ্দেক (১৫)। সহজ ক্যাচ নিয়েছেন বোলার নিজেই।
রান তোলার তাড়ায় বুমরাহর পরের ওভারে ফিরেছেন মাহমুদউল্লাহও (২১)। ডাউন দ্য উইকেটে এসে খেলতে চেয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ, কিন্তু বুমরাহর ইয়র্কারে উড়ে নিয়ে গেছে অফ স্টাম্প। ৪৫ ওভারে ২২৪ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তখন অলআউট হওয়ার শঙ্কায়।
তবে অধিনায়ক মাশরাফি শেষ দিকে দারুণ ব্যাটিংয়ে সেই শঙ্কা দূর করেছেন অষ্টম উইকেটে তাসকিনের (১০*) সঙ্গে মাশরাফির (৩০*) অবিচ্ছিন্ন ৩৫ রানের জুটিতে বাংলাদেশ ৮ উইকেটে তোলে ২৬৪ রান। কিন্তু সেটা লড়াইয়ের জন্য যথেষ্ট হলো না!
অবশ্য বাংলাদেশ সেমিফাইনাল খেলবে, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে এটাই বা কে ভেবেছিল! ঘুরে দাঁড়ানোর অসাধারণ গল্প লিখে নিউজিল্যান্ডকে হারানো, প্রথমবারের মতো আইসিসির বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল খেলা, বাংলাদেশের অর্জন নেহাত কম নয়। সেমিফাইনালে অন্তত লড়াইটা করতে পারলে অর্জনটা আরো সমৃদ্ধ হতো!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৬৪/৭
ভারত: ৪০.১ ওভারে ২৬৫/১
ফল: ভারত ৯ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: রোহিত শর্মা।