স্পোর্টস রিপোর্ট : হাসান আলীর বাউন্সার বলটা উইকেটের পেছনে আকাশে তুললেন জাসপ্রিত বুমরাহ। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে সহজ ক্যাচটা গ্লাভসবন্দি করলেন সরফরাজ আহমেদ। পাকিস্তান অধিনায়ক ক্যাচটা ধরেই দিলেন ভোঁ দৌড়। জড়িয়ে ধরলেন শোয়েব মালিককে। তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন অন্য সতীর্থরাও। পাকিস্তানের সব খেলোয়াড় জড়ো হয়ে দিলেন সিজদা। এরপর গোল হয়ে দাঁড়িয়ে চলল আনন্দ নৃত্য।
অমন বাঁধনহারা উল্লাস তো হবেই! চ্যাম্পিয়নস ট্রফি শুরুর আগে যে পাকিস্তানকে কেউ গোনায় ধরেনি, সেই দলই হলো টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন! ওভালের ফাইনালে আজ ভারতকে ১৮০ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছে পাকিস্তান। যেটি আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে কোনো দলের সবচেয়ে বড় জয়।
এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান। গ্রুপ পর্বের সেই ম্যাচে ভারতের কাছে নাকানি চুবানি খেয়েছিল পাকিস্তান। ২৮৯ রান তাড়া করতে নেমে পাকিস্তান অলআউট হয়েছিল মাত্র ১৬৪ রানে। ফাইনালে ভারতকে তার চেয়েও ৬ রান কমে অলআউট করে মধুর প্রতিশোধই নিল সরফরাজের দল। ভারতের ইনিংস গুটিয়ে গেছে মাত্র ১৫৮ রানে!
ভারতের জন্য ম্যাচটা কঠিন হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানের ইনিংস শেষ হওয়ার পরই। ফখর জামানের সেঞ্চুরিতে পাকিস্তান গড়েছিল ৩৩৯ রানের বড় সংগ্রহ। জিততে হলে ভারতকে রেকর্ডই গড়তে হতো। ওভালে সর্বোচ্চ ৩২২ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড শ্রীলঙ্কার, এবারের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে এই ভারতের বিপক্ষেই। যেটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ইতিহাসেও সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড। শিরোপা ধরে রাখতে ভারতকে গড়তে হতো নতুন রেকর্ড। কিন্তু জয় দূরে থাক, ন্যূনতম লড়াইটাও করতে পারল না বিরাট কোহলির দল।
প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা জিতল পাকিস্তান। ১৯৯২ বিশ্বকাপের পর এই প্রথম আইসিসির ৫০ ওভারের টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হলো তারা।
পিঠের চোট মোহাম্মদ আমিরকে সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে দিয়েছিল। আজ দলে ফিরেই জাদু দেখালেন বাঁহাতি পেসার। আমিরই গুঁড়িয়ে দেন ভারতের টপ অর্ডার। ইনিংসের তৃতীয় বলেই রোহিত শর্মাকে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলে বিদায় করেন তিনি। ভারত তখন রানের খাতাই খুলতে পারেনি।
আমিরের পরের ওভারে স্লিপে কোহলির সহজ ক্যাচ ফেলেন আজহার আলী। কোহলির তখন ৫ রান। ৩ রানে জীবন পেয়ে সেঞ্চুরি করেছিলেন পাকিস্তানের ফখর। তবে কি কোহলিও তেমন কিছু…। না, ভারত অধিনায়ক আউট হয়েছেন পরের বলেই! পয়েন্টে শাদাব খানকে ক্যাচ দিয়ে কোহলি যখন ফিরলেন, ৬ রানেই ২ উইকেট নেই ভারতের!
দলীয় ৩৩ রানে আবার আমিরের আঘাত। সরফরাজ আহমেদের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ধাওয়ান (২১)। ১৩ ও ১৪- পরপর দুই ওভারে যুবরাজ সিং ও মহেন্দ্র সিং ধোনি ফিরে গেলে বিপদে পড়ে যায় ভারত। শাদাবের বলে যুবরাজ হয়েছেন এলবিডব্লিউ। পরের ওভারে হাসান আলীর বাউন্সার পুল করতে গিয়ে ইমাদ ওয়াসিমকে ক্যাচ দিয়েছেন ধোনি।
টেকেননি কেদার যাদবও। শাদাবের বলে সরফরাজের হাতে ক্যাচ দিয়েছেন তিনি। ৭২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে তখন ভীষণ বিপদে ভারত। একশ হওয়া নিয়েই শঙ্কা। সেই শঙ্কা দূর করেছেন হার্দিক পান্ডিয়া। ভারতীয় সমর্থকদের মনে কিছুটা আশাও জাগিয়েছিলেন তিনি।
শাদাবকে টানা তিন ছক্কা হাঁকিয়ে পান্ডিয়া ফিফটি তুলে নেন ৩২ বলে। রবীন্দ্র জাদেজার সঙ্গে তার সপ্তম উইকেট জুটি তুলে ফেলেছিল ৮০ রান। কিন্তু এরপরই ভুল বোঝাবুঝিতে রানআউটে কাটা পড়েন পান্ডিয়া (৪৩ বলে ৭৬)। কার্যত ম্যাচও শেষ হয়ে যায় সেখানেই।
পরের ব্যাটসম্যানরা কেবল ভারতের পরাজয়ের ব্যবধানই কমাতে পারে। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে বুমরাহকে ফিরিয়ে পাকিস্তানের জয় নিশ্চিত করেন হাসান। ১৯ রানে ৩ উইকেট নিয়েছেন তিনি। আমিরও নিয়েছেন ৩ উইকেট, ১৬ রান দিয়ে।
এর আগে টস জিতে পাকিস্তানকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিলেন কোহলি। বোলিংয়ে ভারতের শুরুটা হতে পারত দারুণ। চতুর্থ ওভারে জাসপ্রিত বুমরাহর বল ফখর জামানের ব্যাটে চুমু খেয়ে জমা পড়েছিল উইকেটকিপার মহেন্দ্র সিং ধোনির গ্লাভসে। কিন্তু সেটি ছিল ‘নো’ বল!
৩ রানে জীবন পাওয়া ফখর ও আজহারের ব্যাটে দারুণ সূচনা পায় পাকিস্তান। দুজন গড়েন শতরানের উদ্বোধনী জুটি। ফখরের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে আজহার (৫৯) রানআউট হয়ে গেলে ভাঙে ১২৮ রানের বড় জুটি। ভারতের বিপক্ষে আইসিসি টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের শতরানের উদ্বোধনী জুটি এটিই প্রথম।
আজহার ফিফটি করে ফিরলেও ফখর তুলে নিয়েছেন সেঞ্চুরি। এই চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেই ওয়ানডে অভিষেক হওয়া বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ফিফটি করেছিলেন ৬০ বলে। পরের পঞ্চাশ করেছেন মাত্র ৩২ বলে! ৯৬ থেকে রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে চার হাঁকিয়ে ৯২ বলে ছুঁয়ে ফেলেন তিন অঙ্ক।
সাঈদ আনোয়ার ও শোয়েব মালিকের পর তৃতীয় পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হিসেবে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেঞ্চুরি করলেন ফখর। এটি তার প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি।
হার্দিক পান্ডিয়ার বল উড়িতে মারতে গিয়ে রবীন্দ্র জাদেজার ক্যাচ হওয়ার আগে ১১৪ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন ২৭ বছর বয়সি ব্যাটসম্যান। তার ১০৬ বলের ইনিংসে ছিল ১২টি চার ও ৩টি বিশাল ছক্কার মার। ফখরের বিদায়ের সময় পাকিস্তানের সংগ্রহ ছিল ৩৩.১ ওভারে ২ উইকেটে ঠিক ২০০ রান।
তৃতীয় উইকেটে জুটি বেঁধে দলকে ২৪৭ পর্যন্ত টেনে নিয়েছেন বাবর আজম ও শোয়েব মালিক। ২০ রানের মধ্যে অবশ্য দুজনই ফিরেছেন সাজঘরে। ভুবনেশ্বর কুমারের বলে কেদার যাদবকে ক্যাচ দেওয়ার আগে মালিক করেছেন ১২। বাবর ৪৬ করে যাদবের বলে ক্যাচ দিয়েছেন যুবরাজ সিংকে।
২৬৭ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর পাকিস্তানকে সাড়ে তিনশ’র কাছাকাছি পুঁজি এনে দেওয়ার বড় কৃতিত্ব হাফিজের। পঞ্চম উইকেটে ইমাম ওয়াসিমের সঙ্গে ৪৫ বলে অবিচ্ছিন্ন ৭১ রানের জুটি গড়ার পথে হাফিজ ফিফটি করেন ৩৪ বলে। ৩৭ বলে ৪ চার ও ৩ ছক্কায় ৫৭ রানে অপরাজিত ছিলেন হাফিজ। ২১ বলে অপরাজিত ২৫ রান করেন ইমাদ।
পাকিস্তানের সেই রান পাহাড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেল ভারত!
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
পাকিস্তান: ৫০ ওভারে ৩৩৮/৪ (ফখর ১১৪, আজহার ৫৯, হাফিজ ৫৭*; যাদব ১/২৭, ভুবনেশ্বর ১/৪৪, পান্ডিয়া ১/৫৩)
ভারত: ৩০.৩ ওভারে ১৫৮ (পান্ডিয়া ৭৬, যুবরাজ ২২, ধাওয়ান ২১; আমির ৩/১৬, হাসান ৩/১৯, শাদাব ২/৬০)
ফল: পাকিস্তান ১৮০ রানে জয়ী এবং ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি চ্যাম্পিয়ন
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: ফখর জামান
ম্যান অব দ্য সিরিজ: হাসান আলী।