আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকির অভাব আর কর্তৃপক্ষের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে আবাসিক হোটেলে খুনখারাবির ঘটনা ঘটেই চলেছে। সেখানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় না বললেই চলে। শুধু রাজধানীর হোটেলগুলোতেই গত ১০ বছরে প্রায় ৪০০ খুন সংঘটিত হয়েছে। এসব খুনের বেশির ভাগ ঘটনার রহস্য পর্যন্ত উদ্ঘাটিত হয়নি। আছে বেশুমার জুয়াবাণিজ্য। নারীর ওপর সহিংসতা ছাড়াও মানব পাচারেরও প্রধান ঘাঁটি হয়ে দাঁড়িয়েছে হোটেলগুলো। এসব ছাড়াও অসামাজিক কার্যকলাপ, প্রতারণার মাধ্যমে নগ্ন ছবি ধারণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও জুয়ার আসরসহ আবাসিক হোটেলগুলোতে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। প্রশাসন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ব্যবসা চালাচ্ছেন অধিকাংশ আবাসিক হোটেল মালিক। আবাসিক হোটেল থেকে পুলিশের নিয়মিত চাঁদা নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর আবাসিক হোটেলগুলোর মধ্যে ৮০ ভাগই অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। হোটেল ব্যবসা করার জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স পর্যন্ত তাদের নেই। গোয়েন্দাতথ্য অনুসারে, ছোট-বড় মিলিয়ে রাজধানীতে সাড়ে আট শতাধিক আবাসিক হোটেলের মধ্যে মাত্র ১৭৮টির লাইসেন্স রয়েছে। স্থানীয় মাস্তান-সন্ত্রাসী ও পুলিশের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে বাকি প্রায় ৮০০ হোটেল সচল রাখা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) রাজধানীর আবাসিক হোটেল মালিকদের প্রতি বোর্ডার এন্ট্রি ফরমে বোর্ডারদের নাম, ঠিকানা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও মোবাইল ফোন নম্বর লেখার এবং তা সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়। একই নির্দেশনায় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং বোর্ডারদের ছবি তুলে রাখার কথাও বলা হয়। অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য বোর্ডারের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তা সঠিক কি না তাও তাত্ক্ষণিকভাবে যাচাই করে নেওয়ার ব্যাপারে ডিএমপির নির্দেশনা রয়েছে। সর্বশেষ পূরণ করা তথ্য ফরমের ফটোকপি প্রতিদিন সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠানোর নির্দেশ থাকলেও হোটেল মালিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর কোনোটাই অনুসরণ করেন না। ফলে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলেও পুলিশ সদস্যদের পক্ষে অপরাধী শনাক্ত করা কিংবা দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির পরিচিতজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। একই সঙ্গে সাধারণ বোর্ডারদের নিরাপত্তার বিষয়টিও থেকে যায় ঝুঁকির মুখে। তবে এ ক্ষেত্রে হোটেল মালিকদের আইনি নির্দেশনা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতাই শুধু নয়, হোটেলগুলোর প্রতি সংশ্লিষ্ট থানার সঠিক তদারকি না থাকাও অনেকাংশে দায়ী বলে অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে। আবার কিছু আবাসিক হোটেলের মালিক ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে বাড়তি লাভের আশায় হোটেলের অভ্যন্তরে অসামাজিক কার্যকলাপ, প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও জুয়ার আসরের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীতে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, র্যাডিসন বা ওয়েস্টিনের মতো বড় হোটেলগুলো ছাড়া মাঝারি ও ছোট মানের হোটেলগুলোতে নিজস্ব কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। নেই সিকিউরিটি গার্ড, হোটেলের ভেতরে প্রবেশে কোনো কড়াকড়িও নেই। বোর্ডার ছাড়াও বাইরের লোকজন অবাধে হোটেলে যাতায়াত করতে পারে। ফলে এসব হোটেলে যে-কেউ যে কোনো সময় ঢুকে অঘটন ঘটিয়ে চলে যেতে পারে। তবু আর্থিক সামর্থ্যের দিকে তাকিয়ে এসব হোটেলেই থাকতে হয় সাধারণ মানুষকে। কথা হয় বেসরকারি কর্মকর্তা আবু তাহেরের সঙ্গে। প্রায়ই তাকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ঢাকায় আসতে হয়। তিনি বলেন, ‘এত নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করলে বড় হোটেলগুলোতে থাকতে হবে। সেগুলোতে থাকার সামর্থ্য আমার মতো অল্প আয়ের মানুষের নেই। ঝুঁকি থাকলেও নিজের যে সামর্থ্য, তাতে ছোট বা মাঝারি মানের হোটলগুলোই আমাদের ভরসা। ’ তিনি বলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব সরকারের। হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকারি উদ্যোগে নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া উচিত। পুলিশের এক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা বলেন, আবাসিক হোটেলগুলোতে নানা অপরাধ ও অসামাজিক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়। হোটেলে সিসিটিভি বসালে এসব খারাপ কাজের রেকর্ড থেকে যায়। তাই হোটেল মালিকরা বেশি টাকা খরচ করে অন্যভাবে ম্যানেজ করলেও সিসিটিভি ক্যামেরা কিংবা বোর্ডারদের ছবি তুলে রাখতে চান না। একাধিক মানবাধিকার সংস্থা রাজধানীর আবাসিক হোটেলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠ কে জানায়, আবাসিক হোটেলেগুলোতে হত্যাকাণ্ড নানা কারণে ঘটে। একটি অংশ নিজেদের শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য ভুল তথ্য দিয়ে হোটেলের কক্ষ ভাড়া করে। এ ক্ষেত্রে তারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বোর্ডার পরিচিত হওয়ায় হোটেল কর্তৃপক্ষ কোনো তথ্যই লিপিবদ্ধ করে না। পরে যে কোনো বিষয় নিয়ে নারী-পুরুষের দ্বন্দ্বের জের ধরে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে। দুষ্কৃতকারীদের আরেক অংশ মিথ্যা প্রেমের অভিনয় করে, বিয়ে-চাকরি ইত্যাদির প্রলোভন দেখিয়ে হোটেলে নিয়ে যায় তরুণীদের। পরে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার জন্য নির্যাতন করা হয়। গণধর্ষণ, মারধরসহ কোনো নির্যাতন থেকেই ওই তরুণীদের রেহাই দেয় না দুর্বৃত্তরা। এসব কারণেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া অর্থ লুটসহ শত্রুতার জের ধরেও ঘটে হত্যাকাণ্ড। এসব হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে হত্যার পর লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের অসাধু কর্মকর্তারাই দায়ী। নানা তথ্যসংবলিত ফরম পূরণ, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি গ্রহণ ও আলোকচিত্র ধারণের নিয়ম থাকলেও হোটেলগুলো তা না মেনেই বোর্ডারদের কক্ষ ভাড়া দিয়ে থাকে। এ কারণে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও সঠিক তথ্যের অভাবে জড়িতদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না। হোটেলগুলোতে বিধিমালা কার্যকর করতে প্রশাসনে কোনো তত্পরতা নেই। মগবাজার, মহাখালী, কারওয়ান বাজার ও সায়েদাবাদ এলাকার হোটেলগুলোর প্রায় প্রতিটিই অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা। নেই নিরাপত্তা। আর অসামাজিক কাজ তো এসব হোটেলে ‘ওপেন সিক্রেট’। হোটেলের ভাড়া একেক জায়গায় একেক রকম। মিরপুর এক নম্বর, ফকিরাপুল, কারওয়ান বাজার, নবাবপুর রোড, সায়েদাবাদ, মগবাজার, কাকরাইল, পল্টন ও মহাখালী এলাকার হোটেলগুলোতে এক বিছানার দৈনিক ভাড়া ৭০ থেকে ১৮০ টাকা। একটু উন্নত হলে ভাড়ার হার ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা। দুই বিছানার ভাড়া ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা। একটু ভালো হোটেলে এ হার ৩৫০ থেকে ৭৫০ টাকা। হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা নিজেরাই হোটেলে সুযোগ-সুবিধা ও পরিবেশ বিবেচনা করে ভাড়া নির্ধারণ করে থাকে। আবাসিক হোটেলগুলো বিভিন্ন অপরাধী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলছে এবং সেখানে দেহব্যবসার দালালরাই সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে। হোটেল আল বাবর ও সবুজ বাংলার মালিক সালাউদ্দিন সালু মগবাজার তথা রমনা জোনের হোটেলজগতের নিয়ন্ত্রক। তিনি নিজের হোটেলের বাইরেও এলাকার হোটেলগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। রমনাসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হোটেল ব্যবসায় জড়িত আছেন সোনারগাঁর অনেক পৌর ওয়ার্ড কমিশনার নেতা। অবৈধ ব্যবসাও তাদের নিয়ন্ত্রণে। এদের মধ্যে রয়েছেন সুইডেন প্যালেসের মালিক কমিশনার শামীম, বন্ধন ইন্টারন্যাশনালের মালিক সাবেক কমিশনার নাসির, আরশিনগরের মালিক সাবেক কমিশনার জাহের আলী। রমনা জোনের আরেক অবৈধ ব্যবসায়ী মগবাজার ইন্টারন্যাশনালের মালিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিজান।
তোপখানা রোডের হোটেল গ্রিন বার্ডের ম্যানেজার আলম ও মগবাজারের লোটাস হোটেলের সাবেক সুপারভাইজার এস এস বাঁধন সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিক ব্যবসা করে আসছে। এ সিন্ডিকেট হোটেল শেল্টার, মগবাজারের হোটেল সুইডেন প্যালেস ও লন্ডন প্যালেসে অনৈতিক কার্যক্রম চালায়। আলম নিজেই হোটেল ভবনের মালিক বনে যান।
তেজগাঁও শিল্প এলাকার মহাখালী বাস টার্মিনালের কাছে হোটেল যমুনার ছত্রচ্ছায়ায় চারটি হোটেলে অবাধে অনৈতিক কার্যক্রম চলছে। হোটেল যমুনার মালিক আলমগীর এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে জানা গেছে। এ ব্যবসা পরিচালনা করছেন মাসুদ, মাহাবুব, জুয়েল, উজ্জ্বল, কামাল ও মোল্লা। এরা এলাকার অনৈতিক ব্যবসায়ী বলে চিহ্নিত। মাসুদ ও মাহাবুব ওই এলাকার পাঁচটি হোটেলের মালিক। এসব হোটেলে অবাধে মাদক বাণিজ্যও চলছে।
মহাখালী এলাকার হোটেলে চাঁদাবাজি ও অনৈতিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন পুলক বাবু নামের আন্ডারগ্রাউন্ডের এক দালাল। তিনি অন্তরালে থেকে গোটা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। শিশির নামের এক কথিত সাংবাদিক, পুলিশের সোর্স ও মানবাধিকারকর্মী পরিচয় দানকারী আবাসিক হোটেলগুলোকে কেন্দ্র করে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতারণা। জানা যায়, মুগদাপাড়া এলাকার এ প্রতারকের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন হাজি ও মন্টু। এ প্রতারক চক্র কোনো হোটেল থেকে চাঁদা আদায়ে ব্যর্থ হলে হোটেলে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে অপহরণ ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ তুলেও টাকা আদায় করে নেয়। তাদের এ কাজে সহায়তা করেন কিছু পুলিশ সদস্য। সবুজবাগ থানার এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে তার রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। অনুসন্ধানে দেখা যায়, নিয়মিত প্রকাশ হয় না এমন কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কয়েকজন প্রতারক ঢাকা শহরে চাঁদাবাজি করছেন।
মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠ ডটকম/১৮-০৭-২০১৭ইং/ অর্থ