আমিনুল হক সাদি, নিজস্ব প্রতিবেদক : মঙ্গলবার ১৩ অক্টোবর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এদিন কিশোরগঞ্জের ইতিহাসে কেয়ামতসম ভয়াবহ দিন এসেছিল। পাক হানাদার বাহিনী এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় সদর উপজেলার কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বরইতলা নামক স্থানে নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। নির্মমভাবে গণহত্যা করে চার শতাধিক সাধারণ জনতাকে। এই দিনটি তাই ইতিহাসে এখন বরইতলা গণহত্যা দিবস হিসাবে কিশোরগঞ্জবাসী পালন করে আসছে।
সে দিনে হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলেন কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বরইতলাসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের নিরীহ মানুষ। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হলেও আজও বরইতলার গণহত্যাকান্ডে জড়িত যোদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি। এই বর্বর হত্যাকান্ড থেকে সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন অনেকেই। সেসব স্মৃতি নিয়ে আজও বেঁচে আছেন তারা। এসব পরিবারে বুক ফাটা কান্না থামছে না। বরইতলা হত্যাকান্ডে স্বজনহারা শত শত পরিবার এখনও মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তাদের খবর রাখে না কেউ। এখনও মিলেনি শহীদ পরিবারের মর্যাদা। হয়নি ঘাতকদের কোন বিচার।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭১ সালের এই দিনে প্রায় ১০টার দিকে কিশোরগঞ্জ থেকে ট্রেনে করে পাকবাহিনী ও এ দেশীয় দোসর রাজাকার,আল বদর, আল শামসবাহিনী কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বরইতলা নামক স্থানে এসে নামে। তারা পার্শ্ববর্তী দামপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে ৪/৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করে। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রাণে বাঁচতে কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের দামপাড়া, কড়িয়াইল, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুর, চিকনিরচরসহ আশপাশের গ্রামের লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটাছুটি করতে থাকে। এ সময় পাকবাহিনীর এদেশীয় দোসররা গ্রামের সাধারণ মানুষকে সভা হবে বলে ডেকে বরইতলা নিয়ে যায়। এসব এলাকার সাধারণ মানুষদেরকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়।
এদেশীয় রাজাকার বড়খালের পাড় গ্রামের আবু বাক্কার একজন পাক সেনাকে নিয়ে লুটতরাজ করতে চৌদ্দশত ইউনিয়নের রৌহারকান্দা গ্রামে হানা দেয়। তারা পুরো গ্রামের মহিলাদের নাক কান ছিড়ে স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়।
যাওয়ার পথে পুর্ব জিনারাই গ্রাম থেকে ৭ জনকে ধরে নিয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে আসে। এ সময় এক রাজাকার পাক বাহিনীর কাছে এসে খবর দেয় যে, গ্রামবাসী একজন পাক সৈনিককে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলেছে। এ গুজবের সত্যতা যাচাই না করেই বর্বর পাক বাহিনী হত্যালীলায় মেতে ওঠে। স্থনীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনী বরইতলায় নিরীহ গ্রামবাসীকে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেললাইনের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, লোহার রড এবং রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে।
এই হত্যাকান্ডে প্রায় ৪ শতাধিক গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর এলাকাবাসী বরইতলার নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদনগর’ নাম রাখে। স্থানীয় অধিবাসীদের উদ্যোগে নির্মিত হয় একটি স্মৃতিফলক। পরে ২০০০ সালে সরকারের সহযোগিতায় বরইতলা এলাকায় রেললাইনের পাশে ৬শ ৬৭ বর্গফুট এলাকায় ২৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। দামপাড়া গ্রামের আবদুর রহিমসহ আরও কয়েকজনকে মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আড়াই বছর আগে আ.রহিমের মৃত্যু হয়েছে। রহিমের ভাই, ভাতিজাসহ তার বাড়ির ৯ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বড়ইতলায়। বরইতলা নির্মম হত্যাকান্ডের স্বাক্ষী কিশোরগঞ্জ শহরের আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আ.আজিজ। সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও তার হারাতে হয়েছে ভাই, চাচাসহ পরিবারের ৪ সদস্যকে। তার ভাষায় “সেদিন সারা এলাকায় যেন কিয়ামত নেমে আসে। লাশ দাফন করার মতো কেউ ছিল না। পাক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর আল বদর, আল শামস ও রাজাকার বাহিনীর ভয়ে অনেকে নদীতে স্বজনের মরদেহ ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। নিজের চোখে ২৫/৩০টি লাশ নরসুন্দা নদীতে ভাসতে দেখেছি”। বছর ঘুরে ১৩ অক্টোবর আসলে স্মৃতিসৌধ এলাকা ভাসে শহীদদের স্বজনদের চোখের জলে। জাতীয় শোক দিবস ও বিজয় দিবসে সরকারিভাবে এখানে অর্পণ করা হয় পুস্পার্ঘ্য। কিন্তু বরইতলা গণহত্যায় নিহত পরিবারগুলোর অনেকের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। স্বজনহারা পরিবারগুলোর খোঁজ নেয়নি কেউ। বরইতলা হত্যাকান্ডে জড়িত যোদ্ধাপরাধীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হলেও আজও বরইতলার নির্মম গণহত্যাকান্ডে জড়িতদের বিচার হয়নি।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো.আব্দুল্লাহ আল মাসউদ জানান, বরইতলার নির্মম গণহত্যাকান্ডের ঘটনার ঐতিহাসিক স্থানটিকে সংরক্ষিত করা হয়েছে। স্থানটিকে আরও সৌন্দর্য বর্ধন,বেষ্টনী দেয়াল নির্মাণসহ শহীদ পরিবারদেরকে পুনর্বাসনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।
মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠ ডটকম/১২-অক্টোবর–২০১৭ইং/নোমান