মুক্তকলাম ।। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিক, কলামিষ্ট, কবি ও সাহিত্যিক হযরত মাওলানা আবু জাহীদ কাদরী’র (রহ.) ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ (৭জানুয়ারি)। স্বনামধন্য আলেম, অনলবর্ষী বক্তা, সমাজ সেবক, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও বহু প্রতিভার অধিকারী, বাংলাদেশ তথা মুসলিম সমাজের অন্যতম পুরোধা এই মহান ব্যক্তি ১৯৪৬ ঈসায়ী সনে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার রায়টুটী ইউনিয়নের রাজী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আলহাজ্ব মফিজ উদ্দিন ছিলেন এলাকার একজন নেতৃত্বস্থানীয় ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
আবু জাহীদ কাদরী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন নিজ গ্রামেই। মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ কালে তিনি প্রথমে ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার চকমতি আলীয়া মাদ্রাসা, পরে ফুলপুর উপজেলার প্রখ্যাত বালিয়া মাদ্রাসায় এবং শেষ পর্যায়ে কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ায় শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর পরম শ্রদ্বেয় উস্তাদ নেজামে ইসলাম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও পাকিস্তান পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য হযরত মাওলানা আতহার আলী (রহ.) ও উস্তাদ হযরত মাওলানা আহমদ আলী খান (রহ.) এর পরামর্শক্রমে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী শহরের বিখ্যাত এক কওমী মাদ্রাসায় ভর্তি হন। পাশাপাশী সাধারণ শিক্ষা ব্যাবস্থায়ও পড়া লেখা অব্যাহত রেখে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং মাদ্রাসা থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদীসের ডিগ্রী লাভ করেন।
শিক্ষা জীবন সমাপ্তির পর আবু জাহীদ কাদরী পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী শহরে একটি কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তথায় কয়েক বছর শিক্ষকতা করেন। ছাত্র জীবন ও কর্ম জীবন মিলিয়ে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩ বছর অবস্থান করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দীর্ঘ এক যুগেরও অধিক সময় বাড়ি থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর বাড়ি এসে জানতে পারেন তাঁর ¯েœহের ছোট ভাই রইছ উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে আর বাড়ি ফিরে আসেননি। তিনি তখন ভাই হারানো বেদনায় বিভোর। জীবনে আর কোনোদিন ভাইয়ের দেখা না পেলেও স্বাধীনতার প্রায় তিন দশক পর জানতে পারেন তাঁর ভাই ভারতে আছেন।
দেশে ফিরে আবু জাহীদ কাদরী নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত রাজী হুসাইনিয়া এহ্সানুল উলুম মাদ্রাসায় ৪/৫ বছর শিক্ষকতা করেন এবং মাদ্রাসা সংলগ্ন মসজিদে খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ওই মাদ্রাসায় দুই বছর মুহতামিম (অধ্যক্ষ) ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৯০ সনে মাদ্রাসা ও মসজিদের দায়িত্ব ছেড়ে তাড়াইল উপজেলা সদরে চলে আসেন। তাড়াইলে এসে ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আমৃত্যু সপরিবারে এখানে বসবাস করেন। খ্যাতনামা এ আলেম সদুপায়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য আর্টের কাজ ও সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়ে ছিলেন। দুনিয়ার কোনো লোভ লালসা তাঁর মধ্যে ছিল না। খুবই সহজ-সরল জীবন যাপন করেছেন তিনি। আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি তাঁকে রাতের অধিকাংশ সময় মহান আল্লাহ্ রাব্বুর আলামীনের ইবাদতে মশগুল থাকতে। কখনো কখনো তাসবীহ্-তাহলীল করতে করতে সারা রাত কাটিয়ে দিতেন। তাহাজ্জুদের নামাজে দাঁড়িয়ে প্রায় সময়ই অর্ধ রাত অতিবাহিত করে দিতেন তিনি। আবার ধর্মীয় কোনো বিষয়ে আঘাত আসলে প্রতিবাদী কন্ঠে ঝাপিয়ে পড়তেন আন্দোলনের ময়দানে। সর্বস্তরের ওলামায়ে কেরামকে নিয়ে গড়ে তুলতেন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। ক্ষমতা বা অর্থের মোহ তাঁকে কখনই কাবু করতে পারেনি। তিনি সদা সর্বদা হকের ওপর অটল-অবিচল থাকার চেষ্টা করতেন।
কিশোরগঞ্জ ভাটি অঞ্চলের এ কৃতি সন্তান সারা জীবন মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব ও মানব সেবায় বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন। তাড়াইল ও ইটনা উপজেলার বিভিন্ন সমস্যা তিনি লেখনীর মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের গোচরীভূত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি পাকিস্তানে অবস্থান কালে ৭০ এর দশকে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক হুররিয়াত ও একটি ইংরেজী সাপ্তাহিকের মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। বাংলাদেশে ফিরে দীর্ঘ দিন সাংবাদিকতা থেকে দূরে থাকার পর ১৯৯৫ সনে পুনরায় এ কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত দৈনিক সবুজ, বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রথম দৈনিক পত্রিকা দৈনিক জাহান, রাজধানী ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক খবর, দৈনিক রুপালীসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ ও কলাম লিখতেন তিনি। তাঁর হাতে গড়া হাজার হাজার ছাত্র জাতীয় সংবাদ পত্রের শীর্ষ পদসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি কিশোরগঞ্জের অবহেলিত হাওরা লের নানাবিদ সমস্যা সমাধানে, বি ত মানুষের কল্যাণার্থে অনৈসলামিক কার্যকলাপ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রবন্ধ-নিবন্ধসহ আজীবন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে সচেষ্ট ছিলেন। সাংবাদিকদের অধিকার আদায় এবং বি ত ও নিপিড়িত মজলুম মানবতার পাশে দাঁড়ানোর মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এক ঝাক কলম সৈনিকদের ঐক্যবদ্ধ করে ১৯৯৮ এর ১৪ অক্টোবর তাড়াইল প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমৃত্যু তিনি তাড়াইল প্রেস ক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন। এছাড়াও তিনি মসজিদ, মাদ্রাসা, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও সেবা মূলক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি সব সময় নেতৃত্ব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন। তারপরও নেতৃত্বের গুণাবলী ও অনেক প্রকার অভিজ্ঞতা থাকার ফলে ইচ্ছা না থাকা সত্বেও নেতৃত্ব দিতে হয়েছে সামনে থেকে। তিনি সর্বদায় ওলামায়ে কেরামের ঐক্য ও সংঘবদ্ধ আন্দোলনের জন্য উদ্বুদ্ধ করার পাশাপশি আমরণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এক কথায় বলা চলে সাংবাদিক মাওলানা আবু জাহীদ কাদরী (রহ.) ছিলেন মফস্বল সাংবাদিকদের অনুপ্রেরণা।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ মহান ব্যক্তিত্ব ২০০১ এর ৭ জানুয়ারি, মোতাবেক ১৪০৭ বঙ্গাব্দের ২৪ পৌষ, ১৪২১ হিজরীর ১১ শাওয়াল ভোর রাতে ৫৫ বছর বয়সে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার ছাত্রসহ অসংখ্য গুণগ্রাহীকে শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে মহান আল্লাহ্র সান্যিধ্যে চলে যান। মৃত্যুকালে তিনি ঢাকা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হাসপাতালে বি-ভাইরাস রোগে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও চার মেয়ে রেখে যান।
তাঁর বড় ছেলে এমদাদুল্লাহ্ এক যুগেরও অধিক সময় ধরে সাংবাদিকতার পেশায় নিয়োজিত। বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য জাতীয় দৈনিকে কাজ করেছেন। জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা কিশোরগঞ্জ জেলা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন সমাজ সেবা মূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ছেলে এনায়েতুল্লাহ্ প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিনিধি হিসেবে করেছেন। বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের পাশাপাশী একটি জাতীয় দৈনিকে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত।