মুক্তকলাম ।। শিক্ষা একজন মানুষের মেধা ও মননের সৃষ্টিতে অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকা পালন করে। সেই শিক্ষা লাভের জন্য সকল মনীষীগণই দ্ব্যর্থহীন চিত্তে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছেন। এখনও মানুষ জ্ঞান অর্জনের জন্য বহু ত্যাগ করছে। মফস্বলের চেয়ে শহরের অভিভাবকরা প্রিয় সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে একটু বেশীই উৎকন্ঠায় দিন পার করেন। পছন্দের বিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য সেই ছোটকাল থেকেই কোমলমতি শিশুদের সেই কি প্রস্তুতি! কোমলমতি শিশুটির পাশাপাশি মা-বাবাও ভোগেন এক অজানা উৎকন্ঠায়! চিন্তা একটাই তার ছেলে বা মেয়েটি পছন্দের নামকরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে তো! সেই দৃষ্টিকোন থেকে বর্তমানে কোমলমতি শিশুদের ঘোড়ার দৌড় শুরু হচ্ছে ছোটবেলা হতেই। আর ঐ শিক্ষার্থীর মা-বাবাও এখন সেই দৌড়ের সহযাত্রী। এ দৃশ্য এখন আর অচেনা নয়।
আর এ দৌড়ে টিকতে দিয়ে মধ্যবিত্ত মা-বাবারা তাদের সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। একদিকে দ্রব্যমূলে্যর ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে কিছু অসাধু শিক্ষক-শিক্ষিকার ব্যবসায়িক দুরভিসন্ধি! যা নিয়ে অভিভাবকরা বেশ সংঙ্কটে আছেন। না পারছেন এসব শিক্ষকদের এই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে আঙ্গুল তুলে কিছু বলতে, না পারছেন নিজ সন্তানকে এই ব্যবসায়িক চক্রের বাইরে রাখতে। শিক্ষার ভেতরে এই ভূতের তান্ডব চলছে ভেতরে ভেতরে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, শিক্ষার্থীকে কৌশলে বাধ্য করা হয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে। তার কাছে না পড়লে শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে বিভিন্ন পীড়া দেয়া হয়। সেই পীড়ার ঝাল মাঝে মাঝে অভিভাবকের গায়ে গিয়েও পড়ে। সন্তানকে একটু যত্ন নেয়ার আশ্বাসে অভিভাবকদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করিয়ে নেয়া হয়। অন্য শিক্ষককের কাছে পড়লে আবার শিক্ষার্থীকে দেখে নেয়ার হুমকিও জুটে অনেকের কপালে। আবার যারা ঐ শিক্ষকের কাছে পড়েছে তাদেরকে পরীক্ষার হলে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বিদ্যালয়ে পড়ানোটা একটা সাইনরোর্ড। আসল উদ্দেশ্য হলো নিজের কোচিং সেন্টার ব্যবসার প্রচার-প্রসার ঘটানো। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, শিক্ষকদেরকে কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে সরকারকে বাধ্য হয়ে আলাদাভাবে নির্দেশনা জারি করতে হয়েছে। কিন্তু জারিকৃত নির্দেশনার কতটুকু প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেটি দেখার যেন কেউ নেই!
একটা প্রশ্ন বিবেক কে বেশ তাড়া করে, সেটি হলো কোমলমতি শিশুদের কে আমরা এ কোন শিক্ষায় বড় করে তুলছি? চারদিকে যেন নীতিহীনতার মহোৎসব চলছে। বিবেক, মনুষ্যত্ব, নীতিহীনতার আদর্শকে বাদ দিয়ে হয়তো আমরা সার্টিফিকেটধারী উচ্চ শিক্ষিত জাতি তৈরি করতে পারছি, কিন্তু এ শিক্ষা সামগ্রিক অর্থে এ সমাজের কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। আর এজন্য আমাদের চারপাশে ঘটছে যতসব অনাচার আর অমানবিক কার্যকলাপ! শিক্ষাগুরুর যে উপাখ্যান আমরা ছোটবেলায় শুনেছি, সেগুলো কে এখন রূপকথার গল্প মনে হয়। শিক্ষককেই যখন তারই ছাত্রদের হাতে আহত হতে হয়, ছাত্রের পাশের জন্য নকল সরবরাহ করতে হয়, শুধু তাই নয় ছাত্রের পাশের জন্য প্রশ্ন ফাঁস করার সাথেও এখন শিক্ষকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক লাগে সন্তানতূল্য ছাত্রীর সাথে শিক্ষকের যৌন নির্যাতনের ঘটনা শুনে। কি শিখবে এই ধরণের কুলাঙ্গার শিক্ষকের কাছ থেকে? আর শিক্ষকই বা শিখবে কিভাবে? ঘুষের টাকায় আর রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে যে শিক্ষক তার শিক্ষক হওয়ার কবজকে কব্জা করেছেন, সে নিজেই নীতিহীন, তার কাছে নীতির চর্চা আশা করাও বোকামি।
আমরা সবাই মিলে কি, সর্ষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভূতের বিরুদ্ধে দাড়াতে পারি না? এখন হয়তো কেউ দাড়াতে লজ্জা পাচ্ছি, কিন্তু যেদিন শিক্ষা ব্যবস্থার এই পঁচন সমাজে বড় আকারে ঘাঁয়ের সৃষ্টি করবে, তখন কিন্তু অস্তিত্বের স্বার্থেই সবাইকে রাস্তায় এসে দাড়াতে হবে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিগণ এই সহজ কথাগুলো একটু ভেবে দেখবেন কি?
লেখকঃ সুমিত বণিক, উন্নয়নকর্মী, ঢাকা।