ছানোয়ার হোসেন, সিরাজগনঞ্জ ।। বিষয়টা আমার জন্য বিব্রতকর।অনেক দিন ধরে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত থেকে আমি নিজে যখন কিছু সাংবাদিকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দেখে সমালোচনামূখর হই, তখন আমার সহকর্মী ভাইয়েরা আমার দিকে তেড়ে আসেন। আমাদের এই দেশে সবকিছু গোষ্ঠী বদ্ধভাবে বিবেচনার এক সংস্কৃতি আমরা চালু করেছি। যেখানে যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা সবগুলোকে নিজেদের দলসূত্রে বেঁধে ফেলি। এর মাঝ দিয়ে হয়তো আক্রান্ত হওয়া থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যায়, কিন্তু নিজেদের দায়টুকুর দিকে নজর দেওয়া হয়ে ওঠে না। সব সাংবাদিক নির্যাতনই অপরাধীদের কাজ নয়, কখনও কখনও আমাদের পেশার প্রতি অন্য মানুষের দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ ও হতাশা থেকেও এটি হতে পারে।
আমরা যদি একে বারবার ‘সাংবাদিক নির্যাতন’ বলে এড়িয়ে যাই, তাহলে এরকম ঘটনা বন্ধ হবে না। আমাদেরকে খুঁজে বেড় করতে হবে সাংবাদিকদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনোভাব আসলে কী?
নিজ অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এই মনোভাব খুব আমোদদায়ক নয়। এক শ্রেণির ‘তথাকথিত সাংবাদিকদের’ কর্মকাণ্ডে গোটা বাংলাদেশের মানুষ ধীরে ধীরে এই পেশার প্রতি শ্রদ্ধা হারাচ্ছেন। সম্প্রতি হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর সংবাদ মাধ্যমগুলোর বিভীষিকাময় আচরণ দেখে আমি নিজেই স্তম্ভিত। হুমায়ূন-শাওন পর্ব শেষ করে এখন গুলতেকিনকে নিয়ে শুরু হচ্ছে। হুমায়ূ নের সন্তানদের ফেসবুক থেকে ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে অবলীলায় ছাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হুমায়ূনের চিকিৎসা নিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে রিপোর্ট করা হচ্ছে। আমাদের রুচি-বিকৃতি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাঁর একটি উদাহরণ দিই।
টিভিতে দেখেছি, হুমায়ূনের দাফন শেষে শাওনকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, ‘আপনার শ্বাশুড়ি কেন দাফনে এলেন না? কবরের জায়গা নিয়ে জটিলতায় কি উনি রাগ করেছেন? নুহাশ পল্লীর মালিকানা এখন কার? এটা কার থাকবে?’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
সদ্য স্বামীহারা একজন নারীকে কী প্রশ্ন করা যায়, কতটুকু প্রশ্ন করা যায় এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা না নিয়ে একদল মানুষকে আমরা সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এই সমাজে ছেড়ে দিয়েছি, এটা কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে সেটা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। আমার মনে আছে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে গণতন্ত্রী পার্টির চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের বাড়িতে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তাঁর একমাত্র পুত্র তমোহর ইসলাম ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং গুরুতর আহত নুরুল ইসলামকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শরীরের একটা বড় অংশ পুড়ে যাওয়া মুমুর্ষ নুরুল ইসলাম তখনও জানতেন না যে, তাঁর সন্তান মারা গেছেন। নুরুল ইসলামের মুখের সামনে মাইক্রোফোন নিয়ে আমাদের এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিল, ‘‘আপনার সন্তান মারা যাওয়ায় আপনার অনুভূতি কী?’’
হায়, কী নিষ্ঠুর হতে পারে কিছু মানুষ!
এগুলো কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? অনেকেই হয়তো তা-ই বলবেন, কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রকোপ যখন অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন সেটা এড়িয়ে যাওয়ার আর সুযোগ থাকছে না।
এই সমস্যার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে হরেক রকমের সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহারের সুযোগ। এই সুযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং এই নিয়ন্ত্রণ আরোপে প্রকৃত সাংবাদিকদের সাহসী উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন। মিডিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিভাবান তরুণ তরুণিরা এই সেক্টরে আসছেন না বলে অনেক সময় প্রায় অযোগ্য কিছু মানুষকে দিয়ে কাজ চালানো শুরু হয়েছে। এদের কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেনি অধিকাংশ চাকুরিদাতা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রশিক্ষণবিহীন, সাংবাদিকতা সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানবিহীন অদক্ষরা সদ্য শিং-গজানো বাছুরের মতো বুকে আইডি কার্ড ঝুলিয়ে উন্মত্তের মতো আচরণ করছে। এরা রাস্তায় ট্রাফিক আইন মানে না, সরকারি বেসরকারি অফিসে গিয়ে ধমক দিয়ে কাজ করতে চায়।
এর বাইরে আছে স্বঘোষিত ধান্দাবাজদের ‘সাংবাদিক’ হয়ে ওঠা। পাড়া মহল্লার সাময়িকী এক পাতার কিছু একটা ছাপিয়েই কিছু লোক স্বঘোষিত সাংবাদিক হয়ে পড়ছে। যেনতেন প্রকারে আন্ডারগ্রাউন্ড একটি পত্রিকা বের করে চলছে ব্ল্যাকমেইলিং আর চাঁদাবাজির উৎসব। এসব ‘সাংবাদিক’দের দায় নিতে হচ্ছে প্রকৃত সাংবাদিকদেরকে।
পাঠক কি জানেন, ঢাকা শহরে ‘প্রাইভেট’ নাম দিয়ে যে হাজার হাজার সিএনজি-চালিত ধূষর অটোরিক্সাগুলো চলছে, এগুলোর অনুমোদন নেওয়া হয়েছে এসব ভূইফোঁড় পত্রিকা আর সংবাদ সংস্থার নামে? ঢাকা শহরে যতগুলো ‘সাংবাদিক’ স্টিকার লাগানো মাইক্রোবাস চলাচল করে, এর অধিকাংশই আসলে রেন্ট-এ-কারের গাড়ি, এর সঙ্গে প্রকৃত সাংবাদিকদের কোনো সম্পর্ক নেই।
এখন কথা হচ্ছে এসব সামলাবে কে? আমি এজন্য একটি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিধিমালা তৈরির পক্ষে। সব পেশারই লাইসেন্স প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান থাকে। আপনি এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব বই পড়ে ঝালাপালা হয়ে গেলেও চিকিৎসা শুরু করার আগে আপনাকে সনদ নিতে হবে। এই সনদ গ্রহণের মাধ্যমে আপনি ন্যূনতম নিয়মনীতি ও পেশাগত সততার প্রতি অঙ্গীকার করতে হয়। আপনি আইন পাশ করলেও সরাসরি বিচারকার্যে অংশ নিতে পারবেন না। এ জন্য আপনাকে তালিকাভুক্ত ও সনদধারী আইনজীবী হতে হবে। একাউন্টেন্ট হতে হলেও আপনাকে শুধু হিসাববিজ্ঞান জানলে চলবে না, সংশ্লিষ্ট পেশাগত প্রতিষ্ঠানের সনদ নিতে হবে।
এসব সনদের কারণে একজন পেশাজীবী তার নিজের পেশার প্রতি সৎ থাকার অঙ্গীকার করেন। সনদ থাকার কারণে আমরা সাধারণ মানুষরা বুঝতে পারি যে, এই চিকিৎসক কী আইনজীবী আসলেই আমাকে সেবা দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন কি না। সেবা প্রদানে গুরুতর কোনো অনৈতিকতা থাকলে আমরা বিচারপ্রার্থী হতে পারি এবং দায়ী ব্যক্তির সনদ বাতিল করে তাকে পেশা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাই এই ধরনের পেশাদারিত্বের নিবন্ধন ও সনদ একজন মানুষকে নিজ পেশায় দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করে।
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা ও স্পর্শকাতর পেশা। যে কারও হাতে যেভাবে ছুরিকাঁচি তুলে দিয়ে অপারেশনের সার্জন বানিয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য হয় না, একইভাবে যে কারও হাতে কলম-ক্যামেরা-বুম তুলে দিয়ে তাকে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের দায়িত্ব দেওয়াও গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়।
আমি আশা করি সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বের সনদ দেওয়ার এখতিয়ার দিয়ে একটি কর্তৃপক্ষ তৈরির ব্যাপারে মিডিয়া-সংশ্লিষ্ট সকল মহল গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন। এরকম প্রতিষ্ঠানের রূপরেখা কীভাবে হবে, সনদ পাওয়ার জন্য কোনো প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য শর্তাবলী কী হবে এ ব্যাপারে দেশের অভিজ্ঞ সংবাদকর্মীদের সহায়তায় একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া সম্ভব। এই কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের জন্য আচরণবিধি তৈরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে এবং তাদেরকে সেগুলো মেনে চলতে উৎসাহিত ও ক্ষেত্রবিশেষে বাধ্যও করবে।
অনেকেই হয়তো আমার এই প্রস্তাব সাংবাদিক নিয়ন্ত্রণের মনোভাব হিসেবে দেখতে চাইবেন। কিন্তু আমার মনে হয় বরং প্রকৃত সাংবাদিকদেরই উচিত হবে এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া। আমাদের নিজেদের পেশার সুনাম রক্ষার জন্যই সাংবাদিকতার বাগান থেকে আগাছা দূর করার ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে।