মোজাম্মেল হক বর্ণালী ।। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের ৬৬ বছর পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। এখনো দেশের বিচারকার্যের রায়, তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন কিংবা বিভিন্ন দাপ্তরিক কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে ইংরেজিতে। মহান ভাষা আন্দোলনের সুদীর্ঘ ছয় দশক পেরিয়ে গেলেও আজো উপেক্ষিত রয়ে গেছে মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’। সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষা চালুর স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে। বিদেশি ভাষার আধিপত্য, ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে জগাখিচুড়ি শব্দ প্রয়োগ বাংলা ভাষাকে ঠেলে দিচ্ছে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। যেখানে নিশ্চিত ধ্বংসের পথে আমাদের বাংলা ভাষা। অথচ পৃথিবীতে একমাত্র আমরাই সেই জাতি, যে জাতি ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রাজপথ রাঙিয়েছিল বাংলা মায়ের দামাল সন্তান সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিক, সালাউদ্দিনরা। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা পেয়েছি বাংলায় কথা বলার অধিকার। পেয়েছি স্বাধীন বর্ণমালা। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়ে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আসে মহান একাত্তর। একাত্তরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের প্রত্যেক স্থরে বাংলা ভাষা চালু হবে। ৩০ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা দেন, বাংলা হবে দেশের রাষ্ট্রীয় ও সরকারি ভাষা। বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সর্বস্তরে বিশেষ করে সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য ১৯৮১ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুদীর্ঘ কাল পরিক্রমায় ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি দেয়া হয়। ২০০০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো মহাসচিব কোইচিরো মাতসুয়ারা বিশ্বের ১৮৮ দেশে চিঠি দিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটিকে যথাযোগ্য ভাবগাম্বীর্যের মধ্য দিয়ে পালনের আহ্বান জানান। তারপর থেকে শুরু সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিক, সালাউদ্দিনের বুকে রক্তমাখা আমাদের বাংলা বর্ণমালার বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি। এখন ভাষা আন্দোলনের ৬৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো নির্ধারণ করা যায়নি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বানানরীতি। যার উপর ভিত্তি করে সমৃদ্ধ হবে বাংলা ভাষা। প্রত্যেকে যে যার মতো করে বানানরীতি তৈরি করে তা অনুসরণ করছে। বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম, এমনকি ভাষার মাসেও বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যানারে লিখা হয় প্রভাত ফেরি ও র্যালী। কাজেই বাংলা একাডেমী সুস্পস্ট নীতিমালা তৈরি সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ ঘটালে বিকশিত হবে বাংলা ভাষা। স্বার্থক হবে রক্ত নিয়ে অর্জিত বাংলা ভাষা। যার জন্য প্রাণ দিয়ে ছিল বাংলার অকুতোভয় তরুণ প্রাণ। রাষ্ট্রীয়ভাবে অভিন্ন বানানরীতি থাকা প্রয়োজন। বাংলা একাডেমী সরকারের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় তাদের দায়িত্ব একটি একক ও অভিন্ন বানানরীতি প্রণয়ন করে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ ঘটানো।