muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

কিশোরগঞ্জের খবর

কিশোরগঞ্জের হাওরে ধান কাটার ধুম, ন্যায্য মূল্য নিয়ে শঙ্কা

‘বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি, ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্ন ভরে।’ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশও বাতাসে ধানের শব্দ শুনেছেন। দেখেছেন রোদের সোনালি রঙ। জীবনানন্দ দাশের সেই ধান এবার বিস্তীর্ণ হাওরে রোদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধুই সোনালি ধান। আদিগন্ত হাওরের বুকে যেন সোনালি ধানের ঢেউ।

গত বছর আগাম বন্যায় ফসলহানির কারণে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা এক মুঠো ধানও গোলায় তুলতে পারেননি। বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে চোখের সামনে নষ্ট হয় তাদের বহু কষ্টের ফসল। কৃষক কেঁদেছে অঝোরে। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বৈশাখী ঝড় ও বন্যার আশংকা নিয়েই কিশোরগঞ্জের হাওরের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, বাজিতপুর, নিকলী ও কুলিয়ারচর উপজেলায় ধান কাটার ধুম পড়েছে। গত বছরের কথা মাথায় রেখেই এবার আগেই ঘরে ফসল তুলতে চাইছেন হাওরের কৃষকরা। তাই তারা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তারা সবকিছু ভুলে এখন ধান কাটায় ব্যস্ত। বাম্পার ফলন হওয়ায় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে বিভোর তারা। হাওরজুড়ে এখন মিশ্রাবস্থা। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছে সংশ্লিষ্টরা। তবে উৎপাদন খরচের চেয়ে ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় শঙ্কায় আছে কৃষকরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবার জেলায় ৫ লাখ ৫ হাজার ৬শ ১০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন আর অষ্টগ্রামেই জেলার অর্ধেক বোরো জমি আবাদ করা হয়। এই তিন উপজেলায় এবার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৭ হাজার ৮৫৫ হেক্টর জমি।

শুক্রবার হাওর ঘুরে দেখা যায়, আগাম বন্যার ভয়ে কিশোরগঞ্জের হাওরে এবার আগেভাগেই শুরু হয়েছে বোরো ধান কাটা কাজ। বিরি ২৮ জাতের ধানের পাশাপাশি কাটা হচ্ছে বিভিন্ন জাতের হাইব্রিড ধান। বোরো ধানের উৎসবে ভাসছে হাওর। বাতাসে দুলছে সোনালি ধানের শীষ। যেদিকে চোখ যায় কেবল ধান আর ধান। নতুন ধানের গন্ধে মাতোয়ারা চাষি। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে চলছে ধান কাটা। ধান কাটার শ্রমিকরা ছুটছে হাওরে। কিষানিরা মাড়াই করা ধান ওড়াচ্ছে বাতাসে। কিশোরগঞ্জের প্রতিটি হাওরে এখন এমন ছবিই চোখে পড়বে সবার।

তবে ধানে খুশি হলেও দামে খুশি হতে পারছে না তারা। কষ্টে বোনা ধান বাজারে বেচতে গিয়ে মেজাজ চড়ে যাচ্ছে তাদের। এক ধরনের হতাশায় ভুগছে কৃষক। সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করে দিলেও এ দামে ধান বিক্রি হচ্ছে না কোথাও। বর্তমান বাজার দরে ধান বেচলে লোকসান গুনতে হবে তাদের। এরপরও ধার-দেনার চাপে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে অসহায় কৃষক।

গত বছরের ফসলহারা কৃষকরা ধানক্ষেতের পাকা ফসল কর্তনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ধান কাটা, ধান মাড়াই, ধান শুকানো এসব কাজে কৃষাণ-কৃষাণী ও তাদের পরিবারের ছোট বড় সবাই গোলায় ধান তুলতে সার্বক্ষণিক কাজ করছেন মহাউৎসবে। ৬-৭ দিন আগে থেকে ধান কাটা শুরু হয়েছে এ হাওরে। আরও ১০-১২ দিনের মধ্যেই পুরো হাওরের ধান কাটা শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। এদিকে শিশু সন্তানরাও ধানক্ষেতে সহযোগিতা করছে কৃষকদের। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলেও শিলাবৃষ্টির ভয় রয়েছে। তাই পাকা ধান কোনভাবে হারাতে রাজি নন কৃষকরা। পর্যাপ্ত পরিমাণে ধান কাটার শ্রমিক না থাকায় ৫-৬ জন শ্রমিক ও পরিবারের লোকজন নিয়ে ক্ষেতের ধান কাটছেন।

ইটনা উপজেলার বড়হাটি গ্রামের কৃষক আবু ছালেক জানান, এবার ২০ একর জমিতে বোরো ধান চাষ করেছি। ফলনও ভালো। ইতিমধ্যে ৩ একর জমির ধান ঘরে তুলেছেন। বাকি ধান কেটে ঘরে তুলতে চিন্তায় আছি। ঝড়-তুফান হলে উপায় নাই, ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। আর তাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফসলের মাঠে কাজ করছি। এবার নববর্ষ ও পহেলা বৈশাখের আনন্দ নেই।

মিঠামইন উপজেলার গোপদীঘি ইউনিয়নের হাসানপুর এলাকার কৃষক আউয়াল বলেন, এখন আকাশের পানে চেয়ে থাকি কখন কালো মেঘ ভাসে। ভয় হয় কখন ঝড় আসে। সেই সঙ্গে বৃষ্টি ও শিলা পড়লে তো আর ফসলের রক্ষা নাই। তাই যেভাবেই হোক ধান কেটে গোলায় ভরতে হবে। আর তাই ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছি।

অষ্টগ্রাম উপজেলার কৃষক লতিফ মিয়া বলেন, গত বছর হাওরের ফসলহানির কারণে এক ছটাক ধানও পাইনি। সম্পূর্ণ ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ি। ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে আবারও আবাদ শুরু করি। এবার ফসল ভালো হওয়ায় গতবারের কষ্ট বুঝা যাচ্ছেনা।

করিমগঞ্জ উপজেলার পুরান চামড়া হাওরের কৃষক রশিদ মিয়া বলেন, এবার বোরো ধানের ফসল ভালো হয়েছে। আর তাই শ্রমিক নিয়ে ধান কাটায় ব্যস্ত সময় পার করছি। গত বছরের ফসলহানিতে এবার ধান চাষ করতে গিয়ে ঋণের বোঝা বেড়েছে। বোরো ধানের এই ফসলই এবার ভরসা।

বাজিতপুর উপজেলার হাসানপুর হাওরের কৃষক তমিজ উদ্দিন বলেন, আগে বোরো ফসল ঘরে তুলতে হবে। পরে সারা বছরের খাওয়ার ধান রেখে বাকি ধান বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ চিন্তা নিয়ে ফসলের মাঠে-ময়দানে আছি। ফসল তলিয়ে যাবার ভয়েই এবারের বৈশাখের আনন্দ মাটি হয়ে গেছে। গত বছর হাওরের ফসলহানির কারণে এক ছটাক ধানও পাইনি। সম্পূর্ণ ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ি। ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে আবারও আবাদ শুরু করি। এবার ফসল ভালো হওয়ায় গতবারের কষ্ট বুঝা যাচ্ছেনা।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠকে জানান, সময়মত বীজ বিতরণ থেকে শুরু করে কীটনাশক দেয়ায় এবার লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ফলন বেশি হয়েছে। আর কৃষকরা যাতে ধানের ন্যায্য মূল্য পায় সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলেও জানান তিনি।

Tags: