কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-১ আসন। কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন এবং হোসেনপুর উপজেলার একটি পৌরসভা ও ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে পুনর্বিন্যাসকৃত কিশোরগঞ্জ-১ সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রার্থিতা বলতে গেলে একেবারে সুনিশ্চিত। সৈয়দ নজরুল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম সহচরদের একজন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারের তিনি ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। ক্লিনম্যান হিসেবে খ্যাত সৈয়দ আশরাফ শুধু সংসদ সদস্যই নন, তিনি সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রী এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্তান হিসেবে পারিবারিক ঐতিহ্য এবং একজন সৎ, ভদ্র ও বিনয়ী মানুষ হিসেবে ক্লিন ইমেজের অধিকারী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এই আসনের টানা চার বারের সংসদ সদস্য তিনি। তাই ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগ থেকে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতে নারাজ আসনটির আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ঠিক এমনটিই জানালেন দলটির বেশ কয়েকজন।
এছাড়া ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ে দলের হয়ে ভূমিকা পালন করায় তিনি আবির্ভূত হয়েছেন ‘সফলতার প্রতীক’ হিসেবে। ফলে হেভিওয়েট প্রার্থী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সামনে রেখেই আগামী নির্বাচনের জন্য তৎপরতা এবং ঘর গোছাতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে সরকারের বিগত ৯ বছরের সাফল্য ও স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরার চেষ্টা করছে দলটি।
অন্যদিকে, কিশোরগঞ্জে বিএনপিতে কোন্দল আর জট দীর্ঘদিনের। দীর্ঘ ১৫ বছর পর ২০১১ সালের ২রা জুলাই জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হলেও কোন্দল মিটেনি আজও। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদর আসনসহ জেলার সাতটি আসনের মধ্যে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হয় বিএনপি। বিএনপির এমন অভাবনীয় সফলতা থেকেই শুরু হয় নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। দলীয় কোন্দলের জেরে পরে অনুষ্ঠিত আর কোন নির্বাচনেই দলটি তেমন সফলতা দেখাতে পারেনি।
কিশোরগঞ্জ-১ আসনটিতে বহুধা বিভক্ত বিএনপিতে মনোনয়ন পেতে প্রায় অর্ধ ডজন প্রার্থী মাঠে আছেন। কোন্দলে জর্জরিত বিএনপিতে চলছে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের দৌড়ঝাঁপ। তাদের ডিজিটাল ব্যানার-প্ল্যাকার্ড আর পোস্টারে ছেয়ে গেছে এ আসনের দুই উপজেলার ব্যস্ততম সড়ক থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন মনোনয়ন যুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। তাই আগামী নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির প্রার্থিতা নিয়েই মূলত স্থানীয়দের মাঝে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ, জল্পনা-কল্পনা।
আসনটিতে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে মাসুদ হিলালী ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। এরপর তিনবার সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধে নির্বাচন করলেও কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই তাকে হারতে হয়েছিল বলে মাসুদ হিলালী ও তার সমর্থকদের দাবি। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এবারও তারকায় রয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি সাবেক এমপি মো. মাসুদ হিলালী। এছাড়াও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি সাবেক ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ জেলা রেজাউল করিম খান চুন্নু, জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি ওয়ালীউল্লাহ রাব্বানী, জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেল, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আলহাজ ইসরাইল মিয়া, বিএনপি চেয়ারপারসনের তথ্য ও গবেষণা সেলের কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (অব.) সালাহ উদ্দিন আহমেদ সেলু প্রমুখ মাঠে রয়েছেন।
সাবেক এমপি মো. মাসুদ হিলালীকে বর্তমান কমিটিতে সহ-সভাপতির পদ দেয়া হলেও তিনি সেভাবে কমিটির কর্মকাণ্ডে যুক্ত নন, আবার প্রকাশ্য বিরোধীও নন। তিনি নিজের মতো করে নির্বাচনী তৎপরতার অংশ হিসেবে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।রএছাড়াও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি সাবেক ঢাকা বিভাগীয় স্পেশাল জজ রেজাউল করিম খান চুন্নু বর্তমান কমিটি সমর্থিত সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক হিসেবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের মতে, দলীয় কোন্দলের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে কিশোরগঞ্জ-১ আসনের নির্বাচনে। দলীয় কোন্দল ও গ্রুপিংয়ের কারণে এ আসনে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যাও অনেক সময় অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে যায়। দ্বন্দ্ব নিরসনের অসম্ভব সমীকরণকে সামনে রেখেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানাভাবে তাদের নির্বাচনমুখী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এলাকার সঙ্গে সৈয়দ আশরাফের যোগাযোগ কম বলে একটি বদনাম রয়েছে। কিন্তু তিনি এলাকায় কিছু মেগা প্রকল্পের বরাদ্দ এনেছেন। ফলে এলাকার সঙ্গে সম্পর্কহীনতা আর উন্নয়ন কাজের মধ্যে এক ধরনের টানাপড়েন রয়েছে। কাজেই বিএনপিকে এসবের সঙ্গে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে হবে। কিশোরগঞ্জ-১ আসনে ঐক্যবদ্ধভাবে একক প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগের তৎপরতার সামনে দাঁড়ানোর মতো সাংগঠনিক নেতৃত্ব এবং ঐক্যও বিএনপির নেই। সামনের নির্বাচনের জন্য বিএনপির পক্ষে কিশোরগঞ্জ-১ আসনের জন্য বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হবে। নইলে এ আসনে বিনা বাধায় সৈয়দ আশরাফই যে বিজয়ীর হাসি হাসবেন, তা সকলের কাছে প্রায়-নিশ্চিত।
এছাড়াও আসনটিতে বড় দুই দলের পাশাপাশি সিপিবি থেকে জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এনামুল হক ও বাসদ থেকে জেলা কমিটির সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলামের নামও শোনা যাচ্ছে। তবে নির্বাচন মহাজোটগত নাকি দলীয় ভিত্তিতে হবে, এর ওপর নির্ভর করবে সিদ্ধান্ত।
মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠ ডটকম/২৯-এপ্রিল–২০১৮ইং/এন