প্রতিবছরের ন্যায় এবারও উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ঈদ জামাতের জন্য প্রস্তুত কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। ১৮২৮ সালে প্রথম জামাতের পর এবারের ঈদুল ফিতরের জামাতটি হবে ঈদগাহ ময়দানের ১৯১তম জামাত।
এ বছর ঈদ জামাত শুরু হবে সকাল ১০টায়। এতে ইমামতি করবেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও মুফতি মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। বিকল্প ইমাম থাকবেন শহরের বড়বাজার জামে মসজিদের খতিব মাওলানা মো. শোয়াইব ও মারকাস মসজিদের খতিব মাওলানা হিফজুর রহমান খান।
২০১৬ সালের ৭ই জুলাই ঈদ জামাতের বাহিরে পুলিশকে লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলার ঘটনা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে পুলিশ প্রতিহত করে। এই হামলার ঘটনায় ২ জন পুলিশ কনস্টেবল ও পার্শ্ববর্তী বাড়ির এক গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পুলিশের প্রতিরোধের মুখে এক জঙ্গি ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং অপর একজন অস্ত্রসহ ধরা পড়ে। দুই বছর আগের জঙ্গি হামলার ঘটনাকে মাথায় রেখে গতবছরের মতো এবারো জোরদার করা হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিরাপত্তা পরিকল্পনায় প্রথমবারের মতো যুক্ত করা হয়েছে ড্রোন। নিরবচ্ছিন্ন নজরদারির জন্য ২টি ড্রোন উড়বে শোলাকিয়ায়।
মাঠ ও মাঠের আশপাশ এলাকায় ড্রোনে পর্যবেক্ষণ ছাড়াও ঈদগাহ ময়দানের বাইরে, ভেতরে ও প্রবেশ পথে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ঈদগাহ ময়দান, আশেপাশের এলাকা এবং অলিগলিসহ মাঠ সংলগ্ন চারপাশের অন্তত দুই কিলোমিটার এলাকা নিয়ে আসা হচ্ছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় আওতায়। মাঠে স্থাপন করা হয়েছে ছয়টি ওয়াচ টাওয়ার। এর চারটিতে পুলিশ বাহিনী ও দুইটিতে র্যাব বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে ঈদজামাতের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা তদারকি করবেন। এরই মধ্যে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে পুলিশ। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শহর এবং আশপাশের এলাকায় বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। বিজিবি, র্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান, আরআরএফসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই হাজারেরও বেশি সদস্য দিয়ে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হবে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানকে। এছাড়াও মাঠের প্রতিটি প্রবেশ পথে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশিও করা হবে।
জামাতে অংশ নিতে রাষ্ট্রপতি, জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদ সদস্যসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ঈদগাহ কমিটির পক্ষ থেকে। সেই সঙ্গে বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকায় বিষয়টি মাথায় রেখেই এবার ঈদুল ফিতরের সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে ঈদগাহ কমিটি ও জেলা প্রশাসন।
সুষ্ঠুভাবে জামাত অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে পৌরসভা, গণপূর্ত, জনস্বাস্থ্য, পিডিবিসহ অন্যান্য বিভাগের সহায়তায় গ্রহণ করা প্রস্তুতিমূলক কাজগুলোও বর্তমানে শেষ পর্যায়ে। এরই অংশ হিসেবে সম্পন্ন হয়েছে কাতারের লাইন টানা, বিদ্যুতিক লাইন সংযোজন, মাঠ পরিস্কারকরণ, পানি সরবরাহকরণ, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নসহ রঙের প্রলেপ দেওয়ার কাজ। সংস্কার করা হয়েছে ঈদগাহে প্রবেশের সড়ক ও পাশের পুকুরটিও। উপমহাদেশের বৃহত্তম ঈদ জামাত আয়োজন করতে পেরে গর্বিত কিশোরগঞ্জবাসী।
দীর্ঘ দিনের রীতি অনুযায়ী বিপুল সংখ্যক মুসল্লির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নামাজ শুরুর পাঁচ মিনিট আগে তিনটি, তিন মিনিট আগে দুটি এবং এক মিনিট আগে একটি শটগানের ফাকাঁ গুলি ছোড়া হবে। দূর দূরান্ত থেকে জামাতে অংশগ্রহণ করতে আসা মুসল্লিদের সুবিধার্থে সরকারীভাবে এবারও থাকছে ‘শোলাকিয়া স্পেশাল’ নামের দুটি বিশেষ ট্রেন। ট্রেন দুটির মধ্যে একটি ভোর সাড়ে ৫টায় ময়মনসিংহ থেকে অপরটি সকাল ৬টায় ভৈরব থেকে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসবে।
পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠকে জানান, উড়ন্ত ড্রোন থেকে নজরদারি ছাড়াও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তার অংশ হিসেবে পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি মোতায়েন থাকবে ৫ প্লাটুন বিজিবি। ঈদগায় ফায়ার সার্ভিস এবং মেডিক্যাল টিমও থাকবে। এছাড়া ঈদগাহ ও এর আশপাশের এলাকা পর্যাপ্ত সংখ্যক সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। থাকবে আর্চওয়ে এবং মেটাল ডিটেক্টর। সবার সহযোগীতায় লাখো লাখো মুসল্লির অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণভাবে ঈদের জামাত সম্পন্ন করা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠকে জানান, জামাত নির্বিঘ্ন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ঈদের জামাত অনুষ্ঠানের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে শুধু জায়নামাজ নিয়ে মুসল্লিদের মাঠে ঢুকতে দেওয়া হবে। এরই মধ্যে মাঠে কাতারের দাগ কাটা, বালু ফেলা, দেয়ালে রং করা, পরিচ্ছন্নতাকরণসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে। ঈদের দিন পর্যন্ত এলাকার কোন বাসায় যাতে নতুন কোন ভাড়াটে না ওঠে সে জন্য বাড়িওয়ালাদের আহ্বান জানানো হয়েছে। অচেনা কোন লোক এলাকায় ঘোরাফেরা করলে সে সংক্রান্ত তথ্য পুলিশকে প্রদানের জন্য অনুরোধ জানান তিনি।
ইতিহাস সূত্রে জানা গেছে, ১৮২৮ সালে শোলাকিয়া ঈদগাহে ঈদের বড় জামাত অনুষ্ঠিত হলেও এর যাত্রা শুরু হয় ১৭৫০ সালে। এ হিসাবে শোলাকিয়া মাঠের আড়াইশ বছরেরও বেশি সময়ের ঐতিহ্য রয়েছে। মসনদ-ই-আলা ঈশাখাঁর ৬ষ্ঠ বংশধর দেওয়ান হয়রত খানের উত্তরসূরী দেওয়ান মান্নান দাদ খান ১৯৫০ সালে ৪.৩৫ একর ভূমি শোলাকিয়া ঈদগাহকে ওয়াকফ করে দেন। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত জমি মিলে বর্তমানে এ জায়গার পরিমাণ দাড়িয়েছে ৭ একর। প্রতি বছরই বাড়ছে মুসুল্লীর সংখ্যা। কোন এক সময় এ মাঠে মুসুল্লী হয়েছিল সোয়া লাখ। সোয়া লাখ থেকেইে উচ্চারন বিবর্তনে আজকের শোলাকিয়া।