muktijoddhar kantho logo l o a d i n g

ইসলামের কথা

যেভাবে কাটাবেন ঈদুল ফিতর

শাহ্ মুহাম্মদ আরিফুল কাদের : মুসলমানদের মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বছরে দু’টি পবিত্র উৎসবের দিন উপহার দেওয়া হয়েছে। একটি হলো ঈদুল ফিতর এবং অপরটি হলো ঈদুল আজহা। ঈদ অর্থ- খুশি বা ফিরে আসা। আর ফিতর অর্থ- ফাটল, চির, ভাঙ্গন, ভঙ্গ। এদিক থেকে ঈদুল ফিতর অর্থ- রোজা ভাঙ্গার পর্ব বা উৎসব। কেননা, দীর্ঘ একমাস রোজা রাখার পর মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী এ দিনটিতে রোজা ভেঙ্গে শরিয়াত পন্থায় আনন্দে মেতে উঠি বলে এর নাম ঈদুল ফিতর। যেহেতু ঈদুল ফিতর প্রতি বছর আমাদের কাছে ফিরে আসে এবং এক মাসের শৃঙ্খলা (সুবেহ সাদিক থেকে খাওয়া, পান করা এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা) আল্লাহর নির্দেশে ভঙ্গ করি তাই এটাকে বলা যায় ঈদুল ফিতর।

ঈদের রাতের ফজিলত সম্পর্কে হাদীস শরীফে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- “যে দুই ঈদের রাতে সওয়াবের নিয়তে ইবাদত করবে, তার অন্তর সেদিন মরবে না, যেদিন অন্যদের অন্তর মরে যাবে”। [ইবনে মাজাহ : ১৭৮২] ঈদের রাতে দোয়া কবুল হওয়া সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, (দুনিয়াতে) পাঁচটি রাত এমন আছে; যে রাতগুলোতে বান্দার দোয়া আল্লাহ তা’য়ালা ফিরিয়ে দেন না। অর্থাৎ বান্দার দোয়া কবুল করেন। রাতগুলো হলো- (সাপ্তাহিক) জুমআর রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, শা’বান মাসের ১৫তারিখের রাত, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার রাত। [মুসান্নাফে আব্দুর
রাজ্জাক]

ঈদুল ফিতরের দিন করণীয় কাজসমূহঃ-

১. রোজা না রেখে ঈদের দিন শরিয়াহ পন্থায় খাবারের আনন্দ উপভোগ করা। হাদীস শরীফে ইরশাদ হচ্ছে- “হযরত আবু সাঈদ রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই ঈদের দিন রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন”। [সহিহ বুখারী ও মুসলিম] এমনকি ঈদুল ফিতরের দিন নামাজের পূর্বে (ভোরবেলায়) বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিষ্টি জাতীয় খাবারের কথাও উল্লেখ রয়েছে। “হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ভোরবেলায় প্রথমে কয়েকটি খেজুর খেতেন। তারপর অন্যসব কাজ করতেন”। [সহিহ বুখারী : ৯০৫] তাই ঈদুল ফিতরের দিন রোজা রাখা থেকে দূরে থাকতে হবে এবং সুন্নাত অনুযায়ী খেজুর কিংবা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত।

২.ঈদের দিন নামাজের পূর্বে গোসল করা সুন্নাত। “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন”। [মুয়াত্তা ইবনে মালেক]

৩. ঈদের দিন মিসওয়াক ও সুগন্ধি ব্যবহার করা মুস্তাহাব। “ইমাম মালেক রাহ. বলেন, মুসলিম পন্ডিতগণ প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার ও মিসওয়াক করাকে মুস্তাহাব বলে উল্লেখ করেছেন”। [আল মুগনী]

৪. ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করা মুস্তাহাব। তা নতুন হোক বা ধুয়ে পরিস্কার করা হোক। “হযরত জাবির রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি জুব্বা ছিল, যা পরিধান করে দুই ঈদ ও জুমু’আর দিনে সালাত আদায় করতেন”। [মুসনাদে বায়হাকি]

৫. যাদের উপর ফিতরা ওয়াজিব, তাদের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে আদায় করা কর্তব্য। “হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাক মালদারকে ফিতরা আদায়ে বাধ্যতামূলক করেছেন। যা একদিকে অশ্লীল কথা ও কাজ দ্বারা কুলষিত রোজাকে পবিত্র করে, অপরদিকে অসহায় নিঃস্বকে খাদ্যদানে সহায়তা সৃষ্টি করে দেয়। যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পূর্বে ফিতরা আদায় করবে, তার ফিতরা কবুল করা হবে, অন্যদিকে নামাজের পর আদায় করলে সাধারণ সদকাহ হিসেবে পরিগণিত হবে”। [ইবনে খুজাইমা]

৬. পায়ে হেঁটে ঈদগাহের একদিক দিয়ে প্রবেশ করা এবং অপরদিক দিকে বাহির হওয়া সুন্নাত। “সাঈদ ইবনে যুবাইর রা. বর্ণনা করেন, পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। তবে হেঁটে যেতে সম্ভব না হলে বাহনে চড়ে ঈদগাহে যাওয়া দুষণীয় নয়”।

৭. নিম্নস্বরে তাকবীর বলতে বলতে ঈদগাহে যাওয়া। “হযরত ওমর রা. হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌছার পূর্ব মহূর্ত পর্যন্ত তাকবীর বলতেন। ইমাম মুহাম্মাদ শিহাব আয যুহরী সর্বদা বলতেন; সবার উচিত ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহ পর্যন্ত এভাবে ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহু আকবার আল্লাহু
আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ বলে বলে যাওয়া”। [তাবরানী]

৮. ঈদের সালাত আদায় করা। মহান আল্লাহর ভাষায়- “নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি সাফল্য অর্জন করেছে, যে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করেছে এবং তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করেছে। অতপর সালাত আদায় করেছে”। [সূরা আ’লা ১৪-১৫] উক্ত আয়াতের তাফসীরে সালাত বলতে ঈদুল ফিতরের সালাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে। [আহকামুল কোরআন ৩ : ৪৭৫] ঈদের দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কোনো সালাত আদায় করা ঠিক নয়। কেননা রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো ঈদের সালাতের পূর্বে অন্য(নফল) সালাত আদায় করেন নি। “ইবনে আব্বাস রা. বলেন; রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিন বের হয়ে শুধুমাত্র ঈদের দু’রাকাত সালাত আদায় করতেন, অন্য কোন নফল সালাত আদায় করেন নি”। [সহহি বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি]
তাছাড়াও সামাজিকভাবে আমাদের করণীয় দিকের মধ্যে রয়েছে, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের বিশেষভাবে খোঁজ খবর নেওয়া। সাধ্যমত পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনদের বাসা/বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়ন করা। হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, কাটাকাটি ও অন্যায় ভুলে গিয়ে সবাই ভাই-ভাই হয়ে যাওয়া।

ঈদের দিন যেসব কাজ থেকে বিরত থাকতে হবেঃ-

১. ঈদুল ফিতরের দিনে বা রাতে মহিলাদের বেপর্দাভাবে দাওয়াত করে বেগানা পুরুষ মহিলার সামনে এবং মহিলা বেগানা পুরুষের সামনে সেজে-গুজে আসা-যাওয়া এবং ঘোরাফেরা করা থেকে দূরে থাকা। যা অত্যন্ত গর্হিত কাজও বটে।

২.কোন মানুষ বা প্রানীর ছবি তোলা। অথচ ওই অনর্থক ছবি তোলাকে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারাম ঘোষণা করেছেন। “আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আমি বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শোনেছি যে, যে কেউ দুনিয়াতে কোনো প্রতিকৃতি তৈরী করবে, তাকে কিয়ামতের দিন বাধ্য করা হবে; যেন সে তাতে প্রাণ সঞ্চার করে। অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না। [সহিহ বুখারী : ৫৯৬৩]

৩. গান-বাজনা করা, দেখা কিংবা শোনা থেকে বিরত থাকা। নতুবা ওইসব আনন্দে মেতে উঠে ইমান ধ্বংসেরও সম্ভাবনা রয়েছে। ফতোয়ার ভাষায়-“গান বাদ্যের আওয়াজ শোনা পাপ এবং সেই সব বৈঠকে বসা ফাসেকী এবং তা থেকে স্বাদ উপভোগ বা উল্লাস করা ও আনন্দ করা কুফরী। [বায়যাবীর ফতোয়ায়ে শামী ৬ : ৩৪৮-৩৪৯]

৪. ইসলামের হুকুম লংঘন হয় এমন খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করা বা দেখা ও সহযোগিতা করা। কোরআনের ভাষায়- “আসমান-জমিন ও এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে, তা আমি খেলার উপকরণ হিসেবে সৃষ্টি করিনি”। [সূরা আম্বিয়া : ১৬]

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পানাহার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা (প্রাইভেট), করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ।

 

Tags: